আমীর হামযাহ
মা-বাবার প্রতি সদাচার বা ভালোবাসা, শ্রদ্ধা এবং সেবা একটি মৌলিক নৈতিক কর্তব্য, যা প্রতিটি মানুষের জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আমাদের প্রিয় মা-বাবার প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন একান্তই মানবিক এবং ঈশ্বর কর্তৃক নির্ধারিত একটি ধর্মীয় দায়িত্ব। এই কর্তব্য শুধু পৃথিবীতে শান্তি ও সুখের পথে নিয়ে আসে না, বরং আখেরাতে (পরকালে) আল্লাহর অনুগ্রহ এবং জান্নাতে প্রবেশের জন্যও অপরিহার্য। কুরআন ও হাদীসে এই বিষয়ে যতটুকু গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে, তা বাস্তবিকভাবে আমাদের জন্য একটি শক্তিশালী পথ নির্দেশিকা হিসেবে কাজ করে। মা-বাবার প্রতি সদাচার কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়, কারণ তাঁদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা কখনোই পরিপূর্ণভাবে প্রতিফলিত হতে পারে না।
মা-বাবার প্রতি সদাচারের গুরুত্ব
মা-বাবার প্রতি সদাচার যে কোনো ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত্তিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দায়িত্ব। আল্লাহ তাআলা কুরআনে স্পষ্টভাবে বলেছেন, “তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, তাঁর সঙ্গে কাউকে শরিক করো না এবং মা-বাবার প্রতি সদাচারী হও।” (সূরা আন-নিসা, ৪:৩৬) এই আয়াতটি সুস্পষ্টভাবে বুঝায় যে, আল্লাহর ইবাদত ও তার সঙ্গে কাউকে শিরক (অংশীদারি) না করার পাশাপাশি মা-বাবার প্রতি সদাচার প্রদর্শনও আমাদের মৌলিক কর্তব্য।
মা-বাবার প্রতি সদাচারের গুরুত্ব কেবল আমাদের দুনিয়ায় শান্তি আনয়নই নয়, বরং আখেরাতে আল্লাহর কাছ থেকে পুরস্কৃত হওয়ার জন্যও অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, “আর আমি (আল্লাহ) আদেশ দিয়েছি তোমার সাথে তোমার মা-বাবার প্রতি সদাচার করতে, তোমার মা তোমাকে এক কষ্টের পর এক কষ্ট ভোগ করে গর্ভে ধারণ করেছিলেন…” (সূরা লুকমান, ৩১:১৪)। মা-বাবার কষ্টের তুলনা কোনোকিছুতেই করা সম্ভব নয়। মা গর্ভে ৯ মাস ধরে সন্তানকে ধারণ করেন, এমনকি সন্তান পৃথিবীতে আসার পরও তাঁর সার্বক্ষণিক যত্ন নিতে হয়। আর পিতা, মা-বাবার সব দায়িত্ব পালন করে সন্তানকে সঠিক পথে পরিচালিত করেন। তাই তাঁদের প্রতি সদাচার ও শ্রদ্ধা আমাদের জীবনের অঙ্গ হওয়া উচিত।
পিতা-মাতার অবদান ও কষ্ট
মা-বাবার প্রতি সদাচার করার কারণেই আল্লাহ তাআলা একে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ আমল হিসেবে গণ্য করেছেন। আল্লাহ তাআলা কুরআনে আরো বলেছেন, “তোমার মা, তোমাকে গর্ভে ধারণ করার জন্য অসহনীয় কষ্ট ভোগ করেছেন এবং তোমার দুধপান করানোর জন্যও কষ্ট সহ্য করেছেন।” (সূরা আহকাফ, ৪৬:১৫)। এখানে “অসহনীয় কষ্ট” কথাটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ মা-বাবা কখনোই তাদের সন্তানের জন্য কষ্টের পরিসীমা নির্ধারণ করেন না। তারা নিজেদের সুখের চেয়েও সন্তানের সুখকে বড় করে দেখেন, আবার সন্তানের জন্য নিজেদের স্বাচ্ছন্দ্য ত্যাগ করেন।
মা-বাবার অবদান কেবল শারীরিক নয়, মানসিক ও মানসিক পরিশ্রমের ক্ষেত্রেও তা অপরিসীম। মা তার সন্তানকে নানান দিক দিয়ে বড় করে তোলেন। তিনি তার সন্তানকে যে কষ্টের মধ্যে দিয়ে বড় করেন, তা কখনোই অন্য কেউ সহ্য করতে পারবে না।
বাবা তার সন্তানকে জীবনের সব দিক থেকে উপযুক্ত করে তোলার জন্য প্রতিনিয়ত শ্রম দেন। তার চেষ্টা থাকে সন্তানের শিক্ষা, সংস্কৃতি, নৈতিকতা, আচরণ ইত্যাদিতে উন্নতি সাধন করা। কোনো সন্তান যদি তার মা-বাবার এই নিঃস্বার্থ প্রয়াস ও কষ্টের মূল্য না জানে, তবে সে তার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান আশীর্বাদ হারাবে।
মায়ের অবদান
মা পৃথিবীর সবচেয়ে অমূল্য রত্ন। মা হচ্ছেন সেই মহীয়সী নারী, যিনি নিজের জীবন, সুস্থতা, সৌন্দর্য ও আনন্দ সবকিছু ত্যাগ করেন তার সন্তানের জন্য। মা যেহেতু সন্তানকে গর্ভে ধারণ করেন এবং ৯ মাসের দীর্ঘ সময় ধরে শারীরিক কষ্ট সহ্য করেন, সেহেতু তার অবদান পৃথিবীর সবকিছুর তুলনায় অতুলনীয়। একজন মায়ের কাছে সন্তানের জন্য ভালোবাসা, সহানুভূতি, দয়া ও কোমলতা থাকে সীমাহীন। মায়ের কষ্টের তুলনা করা সম্ভব নয়, একমাত্র আল্লাহই তার সন্তানকে সুস্থভাবে পৃথিবীতে আনার পর থেকে মায়ের সংগ্রাম ও ত্যাগের মূল্য দিতে পারেন।
মা-বাবার কাছে সন্তান প্রতিটি মুহূর্তে এক নতুন স্বপ্ন। মা তার সন্তানের প্রতি বিশেষ যত্নবান থাকেন, তাঁর জন্য নিজেকে ত্যাগ করেন। কখনো খেতে পারেন না, কখনো ভালোভাবে বিশ্রাম নিতে পারেন না, অথচ সন্তানের জন্য তাঁদের সমস্ত কষ্ট মুছে ফেলতে চান। মায়ের অশ্রু, হাসি, আনন্দ, বেদনা – সবকিছুই সন্তানের জন্য।
এক্ষেত্রে কুরআনেও মা-বাবার অবদানকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে বলা হয়েছে, “আমি (আল্লাহ) তোমার মা-বাবাকে যে কষ্ট দিয়েছি, তার সমতুল্য কিছু একটুও তোমার পক্ষে হকভাবে সঠিকভাবে সম্মান দেওয়া সম্ভব নয়।” (সূরা লুকমান, ৩১:১৪)
পিতার অবদান
পিতা মায়ের সমানভাবে সন্তানকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে যে অবদান রাখেন, তা অবর্ণনীয়। পিতা সবসময় সন্তানের পথপ্রদর্শক, অভিভাবক ও নিরাপত্তার রক্ষক। পিতা সন্তানকে অর্থ, শিক্ষা, এবং নৈতিক মূল্যবোধ শেখানোর জন্য তাঁর শ্রম, সময় এবং প্রাণ বিলিয়ে দেন। পিতার শ্রম কখনোই প্রদর্শিত না হলেও, তিনি প্রতিদিনই পরিবারের জন্য কাজ করেন, সন্তানের শিক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে।
সন্তানকে সঠিক পথ দেখানো এবং তার ভবিষ্যৎ গঠন করা পিতার এক অনন্য দায়িত্ব। তাঁরা সবকিছু ত্যাগ করে সন্তানের উন্নতির জন্য পরিশ্রম করেন। পিতার উপকারিতা কেবল দুনিয়াতেই নয়, আখেরাতেও মূল্যবান।
হাদিসের আলোকে মা-বাবার প্রতি সদাচার
হাদিসের মধ্যে আল্লাহর রসূল (সাঃ) মা-বাবার প্রতি সদাচারের ব্যাপারে অনেক গুরুত্ব দিয়েছেন। এক হাদিসে এসেছে, “তোমাদেরকে কি আমি সবচেয়ে বড় বড় গুনাহ বলবো? সাহাবীরা বললেন, হ্যাঁ, ইয়া রাসূলুল্লাহ! তিনি বললেন, ‘আল্লাহর সঙ্গে শিরক করা এবং মা-বাবার অবাধ্যতা করা।'” (সহীহ বুখারি) এখানে এই বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়েছে যে, মা-বাবার প্রতি সদাচারের গুরুত্ব শিরকের থেকেও বেশি।
একটি গুরুত্বপূর্ণ হাদিসে রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “যে সন্তান তার মা-বাবার হক আদায় করবে, সে অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করবে।” (সহীহ মুসলিম)। এই হাদিসে রাসূল (সাঃ) আমাদেরকে জান্নাতের প্রবেশের পথ হিসেবে মা-বাবার হক আদায়ের কথা বলেছেন।
এছাড়া, আরেক হাদিসে এসেছে, “তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম সে, যে তার পরিবারকে সর্বোত্তমভাবে প্রতিপালন করে।” (সহীহ মুসলিম)। এর মাধ্যমে রাসূল (সাঃ) মা-বাবার প্রতি সদাচারের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন।
সন্তানদের জন্য উপদেশ
মা-বাবার প্রতি সদাচার শুধু আল্লাহর জন্য নয়, বরং মানবিক এবং সামাজিক দায়িত্ব হিসেবেও পালন করা উচিত। সন্তানের উচিত তাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া, প্রতিদিন তাদের সম্মান করা, তাদের শখ পূর্ণ করা এবং তাদের কষ্টের কিছুটা হলেও পরিতৃপ্তি দেওয়া।
এছাড়া, সন্তানদের উচিত মা-বাবাকে বৃদ্ধাবস্থায় দেখাশোনা করা, তাদের নিরাপত্তা ও সুস্থতা নিশ্চিত করা। যখন তারা শারীরিক বা মানসিকভাবে দুর্বল হয়, তখন তাদের পাশে দাঁড়ানো।
এছাড়া, সন্তানের উচিত তাদের সন্তানদের মধ্যে ঈমান, নৈতিকতা ও শিক্ষা সংক্রান্ত বিষয়গুলো তুলে ধরা, যাতে তারা পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে মা-বাবার প্রতি সদাচারের মাধ্যমে সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে পারে।
মোট কথা, মা-বাবার প্রতি সদাচার একটি অমুল্য গুণ, যা আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রকে আলোকিত করে। এটি শুধুমাত্র ধর্মীয় বা সামাজিক দায়িত্ব নয়, বরং মানবিক কর্তব্যও। কুরআন এবং হাদীসের আলোকে মা-বাবার প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন এমন একটি মহান আমল, যা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের অন্যতম পথ। এটি শুধু পৃথিবীতে সুখ ও শান্তি আনে না, বরং আখেরাতে জান্নাত লাভের সম্ভাবনা বৃদ্ধি করে। মা-বাবা আমাদের জীবনের একমাত্র ব্যক্তিত্ব, যারা সর্বোচ্চ ত্যাগ ও ভালোবাসার সাথে আমাদের পালন-পালক করেন। তাদের প্রতি সদাচারের মধ্যে রয়েছে এক গভীর সত্য যে, আমাদের এই পৃথিবী এবং আখেরাতের সাফল্য নির্ভর করে তাদের প্রতি আমাদের আচরণের ওপর।
মা-বাবার প্রতি শ্রদ্ধা ও সেবা প্রদর্শন আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। তাদের প্রতি ভালোবাসা, সহানুভূতি, এবং সহযোগিতার মাধ্যমে আমরা নিজেদের চরিত্র উন্নত করতে পারি। তাদের সেবা শুধু শারীরিক নয়, মানসিক এবং আত্মিকও হতে হবে। তাদের প্রতি সদাচার শুধু একজন সন্তানের ভালো কাজ নয়, বরং এটি একটি মহান সামাজিক দায়িত্ব। মা-বাবার প্রতি সদাচারের মাধ্যমে আমরা নিজেদের দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে পারি এবং সমাজে শান্তি ও সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করতে পারি।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, মা-বাবা যখন বয়স্ক বা অসুস্থ হন, তখন আমাদের উচিত তাদের যত্ন নেওয়া এবং তাদের সেবা করা। কেননা, এক সময় ছিল যখন তারা আমাদের ছোট অবস্থায় আমাদের সেবা করেছেন, এবং এখন আমাদের পালা তাদের সেবা করার। আল্লাহ তাআলা কুরআনে স্পষ্ট বলেছেন, “তোমার মা তোমাকে এক কঠিন কষ্টে গর্ভে ধারণ করেছিলেন, আর এক কষ্টের পর আরেক কষ্টে স্তন্যপান করিয়েছেন, অতএব তুমি আমারই পথ অনুসরণ কর, আমি তোমাকে সাহায্য করব” (সূরা লুকমান ৩১:১৪)। এর মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সতর্ক করেছেন যে, মা-বাবার প্রতি কর্তব্য এবং সেবা একটি বিশাল দায়িত্ব।
সর্বোপরি, আমরা যদি আমাদের জীবনে মা-বাবার প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এবং সেবা প্রদর্শন করি, তবে আমাদের জীবন পূর্ণতা লাভ করবে। তাদের দোয়া আমাদের জন্য সর্বদা পরিপূর্ণ আশীর্বাদ হয়ে থাকবে। আমাদের আখেরাতের সফলতা এবং পৃথিবীর শান্তি নির্ভর করবে তাদের প্রতি আমাদের সদাচারের ওপর। তাই মা-বাবার প্রতি শ্রদ্ধা ও সেবা জীবনের লক্ষ্য হওয়া উচিত। যাতে আমরা এই পৃথিবীতে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারি এবং পরকালে জান্নাত লাভের পথে এগিয়ে যেতে পারি।
এভাবেই, মা-বাবার প্রতি সদাচার শুধুমাত্র একটি দায়িত্ব নয়, বরং এটি আমাদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং স্বার্থক আদর্শ হওয়া উচিত, যা আমাদের অন্তরের শান্তি, আখেরাতের সফলতা এবং পৃথিবীর সকল সুখের চাবিকাঠি।
১ Comment
মাশা-আল্লাহ, সুন্দর লেখা