আমীর হামযাহ
একটি শিশুর জন্ম যেমন একটি পরিবারের জন্য আনন্দের, তেমনি একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বও বটে। এই ছোট্ট প্রাণীটি, যে তার নিজের কোনো কাজ করতে পারে না, বড় হয়ে একদিন ভবিষ্যতের নেতা, চিন্তাবিদ এবং সমাজের রক্ষাকারী হয়ে উঠবে। তাই শিশুকে সঠিকভাবে গড়ে তোলা শুধু পরিবারের নয়, সমগ্র সমাজের দায়িত্ব। ইসলামের নির্দেশনাগুলো আমাদের শিশুর সুষ্ঠু পরিচর্যা ও সঠিক শিক্ষা প্রদানের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে। শিশুদের প্রথম থেকেই ইসলামের মূলনীতি শেখানো এবং তাদের চরিত্র গঠনে ভূমিকা রাখা পিতা-মাতার অন্যতম দায়িত্ব।
নবী করিম (সা.) বলেছেন:
“আব্দুল্লাহ (ইবনে উমর রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, নবী (ﷺ) বলেছেন, তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল। কাজেই প্রত্যেকেই নিজ অধীনস্তদের বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। যেমন– জনগণের শাসক তাদের দায়িত্বশীল, কাজেই সে তাদের বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। একজন পুরুষ তার পরিবার পরিজনদের দায়িত্বশীল, কাজেই সে তাদের বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। স্ত্রী স্বামীর ঘরের এবং তার সন্তানের দায়িত্বশীল, কাজেই সে তাদের বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। আর গোলাম আপন মনিবের সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণকারী। কাজেই সে বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। শোন! তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল। কাজেই প্রত্যেকেই আপন অধীনস্তদের বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে।” (সহিহ বুখারি :২৫৫৪)
প্রাথমিক পাঁচটি মূলনীতি শিশুদের ইসলামী শিক্ষায় প্রয়োজনীয়:
১. আকিদার দৃঢ় ভিত্তি স্থাপন
২. ইসলামের প্রতি ভালোবাসা ও আনুগত্যের বোধ জাগ্রত করা
৩. আল্লাহ এবং রাসুলের প্রতি ভালোবাসা ও আনুগত্য শেখানো
৪. সালাত: দ্বীনের মূল স্তম্ভ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা
৫. পিতা-মাতার প্রতি সম্মান এবং দায়িত্ব পালন শেখানো
প্রথম: আকিদার দৃঢ় ভিত্তি স্থাপন
শিশুর জীবনে ইসলামী আকিদা প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নবজাতককে প্রথমে আজানের শব্দ শুনিয়ে যেমন আল্লাহর পরিচয় করানো হয়, তেমনি তার মানসিক গঠনের শুরু থেকেই আল্লাহর অস্তিত্ব ও তৌহিদের ধারণা দেওয়া প্রয়োজন। মহানবী (সা.) বলেছেন, “প্রত্যেক শিশু ফিতরাত (প্রাকৃতিক ধর্মবিশ্বাস) নিয়ে জন্মগ্রহণ করে।” (সহিহ বুখারি)
শিশুকে নিম্নোক্ত তিনটি মূল বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ:
- তার রব কে?
আল্লাহর সুন্দর নাম ও গুণাবলী শেখাও। আল্লাহ একক ও অদ্বিতীয়, তিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন এবং তিনিই আমাদের রিজিক প্রদান করেন। - তার ধর্ম কী?
ইসলাম যে আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস, তার দাসত্ব এবং নৈতিক জীবনের আদর্শ, তা শিশুদের বোঝানো। - তার নবী কে?
মহানবী (সা.)-এর জীবনী, তার শিক্ষা এবং সমাজে তার অবদান সম্পর্কে শিশুদের অবগত করা।
শিশুরা বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বেশি শেখে। তাই তাদের আকিদার শিক্ষা দিতে হলে নিম্নলিখিত পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করা যেতে পারে:
- প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে শিক্ষা: শিশুদের আকিদা সম্পর্কে সহজ ও আকর্ষণীয় প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে তাদের কৌতূহল বাড়ানো।
- আকর্ষণীয় উপস্থাপনা: আল্লাহর অনুগ্রহ ও জান্নাতের বর্ণনা দিয়ে শিশুদের অনুপ্রাণিত করা।
- আল-কুরআন থেকে শিক্ষা: কুরআনের ছোট ছোট সূরার অর্থ সহজ ভাষায় ব্যাখ্যা করে শেখানো।
- দৈনন্দিন জীবনের উদাহরণ: প্রতিদিনের ঘটনাগুলো আল্লাহর নিয়ামত হিসেবে উপস্থাপন করা, যেমন খাবার খাওয়ার সময় রিজিকের জন্য আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ।
দ্বিতীয়: ইসলামের প্রতি ভালোবাসা এবং আনুগত্যের বোধ জাগ্রত করা
শিশুদের মনোভাব গঠনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ইসলামের প্রতি তাদের ভালোবাসা তৈরি করা। আমাদের দায়িত্ব হলো শিশুদের বুঝিয়ে বলা যে ইসলাম তাদের জীবনকে সুন্দর, সুশৃঙ্খল ও পূর্ণাঙ্গ করে তোলে।
- ইতিহাসের আলোকে শিক্ষা: নবী করিম (সা.)-এর যুগের আগে আরব সমাজের অন্যায়-অবিচার, যেমন কন্যাশিশুদের জীবন্ত কবর দেওয়া, দাসপ্রথা ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচনা করা। ইসলাম কীভাবে এই অন্যায়গুলো দূর করে মানবতাকে সম্মান দিয়েছে, তা বোঝানো।
- হারামের কারণ ব্যাখ্যা করা: আল্লাহ কোনো কিছু হারাম করেছেন, কারণ সেগুলো আমাদের ও সমাজের জন্য ক্ষতিকর। যেমন, চুরির ক্ষতিকর দিক ও তার ফলাফল ব্যাখ্যা করে শিশুদের বোঝানো।
- ইসলামের গুণাবলী উপস্থাপন: ইসলাম যে দয়া, ন্যায়, পরিচ্ছন্নতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার শিক্ষা দেয়, তা বোঝানো।
তৃতীয়: আল্লাহ এবং রাসুলের প্রতি ভালোবাসা ও আনুগত্য শেখানো
শিশুর মনে আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলের প্রতি ভালোবাসা গড়ে তোলা আমাদের প্রধান দায়িত্ব। এর জন্য কিছু কার্যকর পদ্ধতি হলো:
- আল-কুরআন পাঠ: শিশুকে কুরআনের আয়াত মুখস্থ করানো এবং এর অর্থ সহজভাবে বোঝানো।
- পরিবারের পরিবেশ: ঘরে ধর্মীয় পরিবেশ বজায় রাখা, যেখানে আল্লাহর স্মরণ, কুরআন পাঠ ও রাসুলের সুন্নত পালন করা হয়।
- দৈনন্দিন উদাহরণ: শিশুকে দেখানো যে আমাদের জীবনের প্রতিটি ভালো কাজ আল্লাহর ভালোবাসা ও পুরস্কার লাভের জন্য।
- সিরাত পাঠ: রাসুল (সা.)-এর জীবনের কাহিনি শিশুদের শোনানো এবং কীভাবে তিনি আমাদের জন্য উদাহরণ হয়ে আছেন, তা বোঝানো।
চতুর্থ: সালাত – দ্বীনের মূল স্তম্ভ
সালাত হলো ইসলামের দ্বিতীয় স্তম্ভ এবং শিশুকে এটি শেখানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নবী করিম (সা.) বলেছেন, “তোমরা তোমাদের সন্তানদের সাত বছর বয়সে সালাত শেখাও।” (আবু দাউদ)
- তিন ধাপে শিক্ষা:
- প্রথম ধাপ (৩-৫ বছর): শিশুকে সালাতের সময় দেখে দেখে অনুকরণ করতে উৎসাহিত করা।
- দ্বিতীয় ধাপ (৫-৭ বছর): সালাতের গুরুত্ব বোঝানো এবং নামাজের সঠিক পদ্ধতি শেখানো।
- তৃতীয় ধাপ (৭-১০ বছর): নামাজ নিয়মিত করার অভ্যাস গড়ে তোলা। প্রয়োজনে কিছুটা কঠোরতাও করা।
পঞ্চম: পিতা-মাতার প্রতি সম্মান এবং দায়িত্ব পালন শেখানো
ইসলামে পিতা-মাতার প্রতি সম্মান ও ভালোবাসার গুরুত্ব অত্যধিক। আল্লাহ বলেন:
“তোমার প্রভু আদেশ করেছেন যে, তাঁকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করো না এবং পিতা-মাতার প্রতি সদয় হও।” (সূরা আল-ইসরা, ১৭:২৩)
শিশুকে নিম্নলিখিত পদ্ধতিতে পিতা-মাতার প্রতি সম্মান করতে শেখানো যেতে পারে:
- সম্মানজনক ব্যবহার শেখানো: শিশুকে পিতা-মাতার সঙ্গে মিষ্টভাষী হতে উৎসাহিত করা।
- পরিবারের উদাহরণ: নিজের পিতা-মাতার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে শিশুর জন্য উদাহরণ তৈরি করা।
- ধর্মীয় শিক্ষা: কুরআনের আয়াত ও হাদিসের আলোকে পিতা-মাতার প্রতি কর্তব্য শেখানো।
- আনন্দের মুহূর্ত তৈরি: বিশেষ দিনগুলোতে পিতা-মাতার জন্য বিশেষ কিছু করার অভ্যাস গড়ে তোলা।
মোট কথা, শিশুদের সঠিক ইসলামী শিক্ষায় গড়ে তোলার দায়িত্ব কেবল একটি পরিবার কিংবা একটি প্রজন্মের নয়; এটি সমগ্র উম্মাহর প্রতি আল্লাহ প্রদত্ত একটি দায়িত্ব। একটি সুনির্মল ও সুশৃঙ্খল সমাজ প্রতিষ্ঠার মূল ভিত্তি হলো শিশুরা, যারা ভবিষ্যতে জাতির পথপ্রদর্শক হবে। ইসলামের আলোকে তাদের গড়ে তোলা মানে একটি নৈতিক, শক্তিশালী এবং আল্লাহভীরু সমাজের ভিত্তি স্থাপন করা।
শিশুদের মনে ঈমান, ইসলামী চেতনা এবং সঠিক চরিত্র গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে আমরা তাদের এমন একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে প্রস্তুত করতে পারি, যারা বিশ্বে আল্লাহর খলিফা হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে। এজন্য প্রয়োজন পরিবার, সমাজ এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের সমন্বিত প্রয়াস। আল্লাহ আমাদের সবাইকে এই মহান দায়িত্ব পালনের যোগ্যতা দান করুন এবং আমাদের সন্তানদের এমন করে গড়ে তুলুন, যেন তারা ইসলাম ও মানবতার সেবায় অনন্য অবদান রাখতে পারে। আমিন।