আমীর হামযাহ
স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক শুধু ভালোবাসা আর আস্থার ওপর ভিত্তি করে গঠিত নয়, বরং এতে পারস্পরিক দায়িত্ব, অধিকার ও সীমারেখাও স্পষ্টভাবে নির্ধারিত। এক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠতে পারে—একজন স্ত্রী কি তার স্বামীর সম্পদের বিস্তারিত জানার অধিকার রাখেন? অথবা স্বামী কি স্ত্রীর আয় ও ব্যয়ের ওপর নজরদারি করতে পারেন? ইসলামী শরিয়ত এই বিষয়ে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা দিয়েছে, যা অনেকেই জানেন না বা অনুসরণ করেন না।
স্বামী-স্ত্রীর আর্থিক সম্পর্ক ইসলামে কেমন হওয়া উচিত?
ইসলাম একজন নারী ও পুরুষকে স্বতন্ত্র আর্থিক সত্তা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। অর্থাৎ, একজন স্ত্রী তার উপার্জন, উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সম্পদ বা পরিবারের কাছ থেকে পাওয়া উপহার সম্পূর্ণরূপে নিজস্ব মালিকানায় রাখতে পারেন। স্বামীর কোনো অধিকার নেই তা জোর করে নেওয়ার বা স্ত্রীকে বাধ্য করার।
মিশরের প্রাক্তন গ্র্যান্ড মুফতি ড. আলী গোমা এই প্রসঙ্গে বলেন:
“ইসলামের বিধানে স্বামী-স্ত্রীর আর্থিক সম্পর্ক এমনভাবে সংগঠিত হয়েছে, যেখানে প্রত্যেকের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বজায় থাকে। স্বামী স্ত্রীর অর্থের ওপর কর্তৃত্ব করতে পারেন না, তেমনি স্ত্রীও স্বামীর অর্থের হিসাব নেওয়ার অধিকার রাখেন না, যদি না স্বামী স্বেচ্ছায় তা প্রকাশ করেন।”
অর্থাৎ, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক যতই ঘনিষ্ঠ হোক, তাদের আর্থিক বিষয়গুলো পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতেই পরিচালিত হতে হবে। একজন স্ত্রী তার স্বামীর সম্পদের বিস্তারিত জানার জন্য তাকে বাধ্য করতে পারেন না, যেমনটি স্বামীও স্ত্রীর আয়ের ওপর সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে পারেন না।
স্ত্রীর সম্পদের ওপর স্বামীর কোনো অধিকার আছে কি?
নারীর সম্পদের ওপর তার নিজস্ব অধিকার রয়েছে, যা কোরআন ও হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। ইসলামে নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কোরআনে বলা হয়েছে—
“হে ঈমানদারগণ, তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না, তবে পারস্পরিক সম্মতিতে বৈধ ব্যবসার মাধ্যমে।” (সূরা আন-নিসা: ২৯)
এই নির্দেশনা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, স্বামী স্ত্রীর সম্পদ নিজের ইচ্ছামতো ব্যবহার করতে পারেন না। যদি স্ত্রী স্বেচ্ছায় কিছু অর্থ দেন, তবে তা গ্রহণ করা যেতে পারে, কিন্তু জোরপূর্বক নেওয়া হারাম।
ড. আলী গোমা আরও বলেন—
“নারী যদি চাকরি করেন, ব্যবসা করেন বা অন্য কোনো উপায়ে সম্পদ অর্জন করেন, তবে সেই সম্পদ তার ব্যক্তিগত মালিকানায় থাকবে। স্বামী যদি তা নিতে চান, তবে স্ত্রীর সম্মতি ছাড়া তা নেওয়া সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ।”
স্বামীর অর্থের ওপর স্ত্রীর অধিকার কতটুকু?
স্বামী পরিবারের মূল উপার্জনকারী হিসেবে বিবেচিত হলেও তার অর্থের ওপর স্ত্রীর সরাসরি কোনো মালিকানা নেই। তবে শরিয়তের বিধান অনুসারে, স্ত্রীর জন্য প্রয়োজনীয় খরচ বহন করা স্বামীর প্রধান দায়িত্ব।
এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে—
✅ খাদ্য
✅ বস্ত্র
✅ বাসস্থান
✅ চিকিৎসা
✅ অন্যান্য মৌলিক চাহিদা
তবে, এটি নিশ্চিত করা হয়েছে যে, স্ত্রীর স্বামীকে তার ব্যক্তিগত অর্থের হিসাব দিতে বাধ্য করার কোনো বিধান নেই, যেমন স্বামীরও স্ত্রীর ব্যক্তিগত সম্পদের ওপর কোনো নজরদারি করার অনুমতি নেই।
কর্মজীবী স্ত্রী কি সংসারের খরচ বহন করতে বাধ্য?
বর্তমান সমাজে অনেক স্বামী মনে করেন, কর্মজীবী স্ত্রীদের সংসারের খরচের অংশ বহন করা উচিত। এমনকি অনেকে বিয়ের আগেই শর্ত দেন যে, স্ত্রীকে তার আয়ের একটি অংশ সংসারের খরচে ব্যয় করতে হবে। কিন্তু শরিয়তের বিধান কী?
ড. আলী গোমা বলেন—
“যদি বিয়ের সময়ই স্বামী-স্ত্রী একমত হন যে স্ত্রী সংসারের কিছু অংশ বহন করবেন, তাহলে তা পালন করতে হবে। তবে ইসলামের মূল বিধান অনুযায়ী, সংসারের যাবতীয় ব্যয়ভার স্বামীর ওপরই অর্পিত হয়েছে।”
অর্থাৎ, যদি স্ত্রী সংসারের খরচে সাহায্য করেন, তবে এটি তার অনুগ্রহ হিসেবে গণ্য হবে, বাধ্যতামূলক কর্তব্য নয়।
যৌথ ব্যাংক হিসাব ও সম্পদ ভাগাভাগি—শরিয়তের দৃষ্টিতে সঠিক কি?
কিছু দম্পতি সংসারের ব্যয় ভাগাভাগি করতে যৌথ ব্যাংক হিসাব পরিচালনা করেন। এটি সম্পর্কের গভীরতার পরিচায়ক হলেও শরিয়ত বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে বলেছে।
ড. আলী গোমা বলেন—
“যৌথ অর্থনৈতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা উচিত, কারণ দাম্পত্য জীবন সবসময় একইভাবে স্থায়ী থাকে না। সম্পর্কের টানাপোড়েন হলে, স্ত্রী বা স্বামী কেউই অন্যের সম্পদ থেকে নিজেদের প্রাপ্য বুঝে নিতে পারবেন না।”
অর্থাৎ, যৌথ খাতে অর্থ রাখার আগে স্বামী-স্ত্রীকে অবশ্যই সুস্পষ্টভাবে চুক্তি করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে কোনো বিরোধ দেখা না দেয়।
স্বামী-স্ত্রীর আর্থিক স্বচ্ছতা—কীভাবে বজায় রাখা যায়?
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও বোঝাপড়া দাম্পত্য সম্পর্ককে সুদৃঢ় করে। আর্থিক বিষয় নিয়ে একে অপরকে সন্দেহ করা, চাপ সৃষ্টি করা বা গোপনীয়তা লঙ্ঘন করা সম্পর্কের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
✅ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে স্বচ্ছতা থাকা উচিত, তবে তা পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে।
✅ স্ত্রীর উচিত নয় স্বামীর সম্পদের ওপর জোরপূর্বক অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চাওয়া।
✅ স্বামীও স্ত্রীর উপার্জনকে নিজের বলে দাবি করতে পারেন না।
✅ অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো উভয়ের মতামতের ভিত্তিতে হওয়া উচিত।
✅ পারিবারিক খরচ ও ভবিষ্যতের পরিকল্পনা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করা উচিত।
স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক পারস্পরিক সম্মান, দায়িত্ব ও ভালোবাসার ভিত্তিতে গড়ে ওঠে। ইসলামে উভয়েরই অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে, তবে তা ন্যায়সংগত ও স্বচ্ছতার সঙ্গে পরিচালিত হওয়া উচিত। স্ত্রী যেমন স্বামীর সম্পদের ওপর জোরপূর্বক অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারেন না, তেমনই স্বামীও স্ত্রীর ব্যক্তিগত সম্পদের ওপর নজরদারি করতে পারেন না।
অর্থনৈতিক বিষয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বোঝাপড়া থাকলে সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় হয়। তাই পারস্পরিক সম্মান ও ভালোবাসার ভিত্তিতে দাম্পত্য জীবন পরিচালিত হওয়াই উত্তম।