আমীর হামযাহ
পরিবার একটি সমাজের ভিত্তি, মানবিক সম্পর্কের প্রথম পাঠশালা। এটি শুধু রক্তের বন্ধন নয়, বরং ভালোবাসা, দায়িত্ব, এবং পরস্পরের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের এক অপূর্ব মিলনক্ষেত্র। কিন্তু আধুনিক যুগের ব্যস্ততা, প্রযুক্তির প্রভাব এবং নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে পারিবারিক বন্ধনগুলো দিন দিন শিথিল হয়ে পড়ছে। এমন অবস্থায়, শান্তিময় পরিবার গঠনের জন্য ইসলামের নির্দেশনা এবং আধুনিক যুগের বাস্তব চাহিদাগুলো একত্রে বিবেচনা করা অত্যন্ত প্রয়োজন। এই প্রবন্ধে আমরা ইসলামের আলোকে এবং আধুনিক জীবনের বাস্তবতায় একটি শান্তিময় পরিবারের গুরুত্ব, সমস্যাসমূহ এবং সমাধান নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
পরিবার: ইসলামের নির্দেশনা ও আধুনিক জীবনের প্রভাব
পরিবার মানবজীবনের একটি অপরিহার্য অংশ। ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে পরিবার হলো শান্তি, ভালোবাসা এবং পারস্পরিক সহযোগিতার কেন্দ্রবিন্দু। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন:
“তারা তোমাদের জন্য পোশাকস্বরূপ, আর তোমরা তাদের জন্য পোশাকস্বরূপ।”
(সূরা বাকারা, ২:১৮৭)
এই আয়াতে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক সুরক্ষা, শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসার গুরুত্ব স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। পোশাক যেমন আমাদের শরীরকে ঢেকে রাখে এবং আমাদের সম্মান রক্ষা করে, তেমনি পরিবারের সদস্যরাও একে অপরের সুরক্ষার আশ্রয়।
আধুনিক মনোবিজ্ঞানীরাও মনে করেন, একটি সুস্থ ও শক্তিশালী সমাজ গড়ে তোলার মূল ভিত্তি হলো একটি সুখী পরিবার। কিন্তু বর্তমান যুগের কর্মব্যস্ততা, প্রযুক্তির প্রতি আসক্তি এবং নৈতিক অবক্ষয় পারিবারিক বন্ধনকে ভেঙে দিচ্ছে।
শান্তিময় পরিবার গঠনের ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি
ইসলাম একটি শান্তিপূর্ণ ও সুখী পরিবার গঠনের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি নির্ধারণ করেছে। সেগুলো অনুসরণ করলে পরিবারে শান্তি, সৌহার্দ্য এবং ভালোবাসা বজায় রাখা সম্ভব।
১. পারস্পরিক ভালোবাসা ও সম্মান
শান্তিময় পরিবারের মূল স্তম্ভ হলো ভালোবাসা ও সম্মান। মহানবী (সা.) বলেছেন:
“তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি উত্তম, যে তার পরিবারের কাছে উত্তম আচরণ করে।”
(তিরমিজি: ৩৮৯৫)
পরিবারের সদস্যরা যদি একে অপরকে সম্মান করেন এবং ভালোবাসেন, তাহলে পারিবারিক জীবনে কখনোই বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে না। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বোঝাপড়া ও সহযোগিতার সম্পর্ক থাকতে হবে, যা তাদের সন্তানদের মনেও ভালো আচরণের বীজ বপন করবে।
২. দায়িত্ববোধ ও ন্যায়পরায়ণতা
পরিবারের প্রতিটি সদস্যের মধ্যে দায়িত্ববোধ থাকা অত্যন্ত জরুরি। ইসলাম দায়িত্ববোধকে পরিবারিক শান্তির প্রধান শর্ত হিসেবে উল্লেখ করেছে। আল্লাহ তাআলা বলেন:
“পুরুষরা নারীদের তত্ত্বাবধায়ক, এ কারণে যে, আল্লাহ তাদের একের উপর অন্যকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন এবং যেহেতু তারা নিজদের সম্পদ থেকে ব্যয় করে। “
(সূরা নিসা, ৪:৩৪)
স্বামীকে তার পরিবারের জন্য রিজিক উপার্জন করতে হবে, এবং স্ত্রীকেও তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হবে।
৩. ধৈর্য ও সহনশীলতা
পরিবারে মতবিরোধ একটি স্বাভাবিক বিষয়। তবে তা সমাধানের জন্য ধৈর্য এবং সহনশীলতা বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তাআলা বলেছেন:
“যারা রাগ দমন করে এবং মানুষকে ক্ষমা করে, আল্লাহ তাদেরকে ভালোবাসেন।”
(সুরা আলে ইমরান, ৩:১৩৪)
এছাড়াও, হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন:
“শক্তিশালী সেই ব্যক্তি নয় যে কুস্তিতে প্রতিপক্ষকে পরাজিত করতে পারে, বরং প্রকৃত শক্তিশালী সেই ব্যক্তি যে রাগের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।”
(সহিহ বুখারি: ৬১১৪, সহিহ মুসলিম: ২৬০৯)
৪. পরিবারে ধর্মীয় চর্চা
শান্তিময় পরিবেশ গড়ে তুলতে পরিবারে ধর্মীয় চর্চা থাকা আবশ্যক। একসঙ্গে নামাজ আদায় করা, কুরআন পাঠ করা এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ শেখানো পরিবারের সকলকে আধ্যাত্মিকভাবে শক্তিশালী করে।
আধুনিক যুগে পারিবারিক সমস্যাসমূহ ও সমাধান
আধুনিক জীবনে প্রযুক্তি, কর্মব্যস্ততা এবং ব্যক্তিস্বার্থের প্রতি অতিরিক্ত মনোযোগ পারিবারিক জীবনের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। নিচে কিছু সাধারণ সমস্যা এবং তার সমাধানের উপায় আলোচনা করা হলো:
১. প্রযুক্তির আসক্তি
প্রযুক্তির প্রতি অতিরিক্ত আসক্তি পারিবারিক সম্পর্কের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করছে। এর সমাধান হিসেবে:
- প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় প্রযুক্তি থেকে বিরত থাকা
- পরিবারের সদস্যদের সাথে মানসম্মত সময় কাটানো
- একসঙ্গে খাবার খাওয়া এবং গল্প করা
২. মানসিক চাপ ও কর্মব্যস্ততা
কর্মজীবনের চাপ পরিবারে সময় দেয়াকে কঠিন করে তুলেছে। সমাধান:
- সাপ্তাহিক সময় পরিকল্পনা করা
- পরিবারের সদস্যদের সাথে একত্রে সময় কাটানোর জন্য ছুটি নির্ধারণ করা
৩. নৈতিক শিক্ষার অভাব
শিশুদের মধ্যে নৈতিক শিক্ষা এবং পারিবারিক মূল্যবোধের অভাব দেখা যাচ্ছে। এর জন্য প্রয়োজন:
- ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান
- পরিবারে নৈতিক আচরণ প্রদর্শন
- গল্প বা অভিজ্ঞতার মাধ্যমে মূল্যবোধ শেখানো
সফল পারিবারিক জীবনের কৌশল
একটি সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ পরিবার গড়ে তুলতে নিচের কৌশলগুলো কার্যকর হতে পারে:
- পরস্পরের প্রতি সহানুভূতি ও সমঝোতা রাখা।
- সক্রিয় যোগাযোগ: পরিবারের সদস্যদের সাথে নিয়মিত আলোচনা করা।
- সময় ব্যয় করা: একসঙ্গে বেড়াতে যাওয়া, খেলাধুলা করা।
- আর্থিক পরিকল্পনা: পরিবারের জন্য সঠিক আর্থিক পরিকল্পনা তৈরি করা।
- ধর্মীয় দীক্ষা: পারিবারিক জীবনে ধর্মীয় মূল্যবোধ বজায় রাখা।
শান্তিময় পরিবার গড়ে তোলা শুধু একটি ধর্মীয় দায়িত্ব নয়, বরং এটি একটি সামাজিক প্রয়োজন। ইসলাম আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে। পারস্পরিক ভালোবাসা, দায়িত্ববোধ, এবং ধৈর্য বজায় রাখার মাধ্যমে পরিবারে সুখ এবং শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব।
পরিবার মানবজীবনের সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ। একে উপেক্ষা করা মানে একটি সুস্থ সমাজের ভিত্তি দুর্বল করা। যদি আমরা সবাই ইসলামের শিক্ষাগুলো অনুসরণ করি এবং আধুনিক যুগের চ্যালেঞ্জগুলোকে সঠিকভাবে মোকাবিলা করি, তাহলে প্রতিটি পরিবার একটি শান্তি ও সুখের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠবে।
১ Comment
মাশা-আল্লাহ জাজাকাল্লাহ খায়র
হে প্রিয় শায়েখ