আমীর হামযাহ
ইসলামের বিধান অনুযায়ী, মা-বাবার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্কের শিষ্টাচার শুধু ইহকালেই নয়, পরকালেও সন্তুষ্টি ও সফলতার জন্য এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ইসলামে তাদের প্রতি সম্মান এবং সদাচার দেখানোকে একটি মহান দায়িত্ব হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। পবিত্র কোরআন ও হাদিসে বারবার মা-বাবার প্রতি উত্তম আচরণ, সম্মান এবং তাদের প্রতি নিঃশর্ত ভালবাসার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই শিষ্টাচার শুধু ধর্মীয় বিশ্বাস নয়, সমাজে সুস্থ, উন্নত এবং মানবিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে অপরিহার্য।
কোরআনে মা-বাবার প্রতি আচরণ
পবিত্র কোরআনে মা-বাবার সঙ্গে ভাল ব্যবহার, তাদের প্রতি স্নেহ ও সম্মান প্রদর্শনের ব্যাপারে স্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সুরা বনি ইসরাঈল (আয়াত: ২৩) এ কথা বলা হয়েছে, “আপনার রব আদেশ দিয়েছেন, তিনি ছাড়া আর কারো ইবাদত না করতে এবং মা-বাবার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে, তাদের একজন বা উভয়ে আপনার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হলে তাদের উফ শব্দও বলো না এবং তাদের ধমক দিয়ো না, তাদের সঙ্গে সম্মানসূচক কথা বলো। মমতাপূর্ণ আচরণের মাধ্যমে তাদের প্রতি বিনয়ী হও এবং বলো, হে আমার রব, তাদের প্রতি দয়া কোরো যেভাবে তারা আমাকে প্রতিপালন করেছিলেন।”
এই আয়াতে মা-বাবার প্রতি সদ্ব্যবহারের জন্য কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কোনো অবস্থাতেই তাদের প্রতি কোনো অসামাজিক বা অপমানজনক শব্দ প্রয়োগ করা যাবে না, এমনকি “উফ” শব্দটিও নয়, যা সাধারণত ক্ষোভ বা অসন্তোষ প্রকাশের জন্য ব্যবহৃত হয়। বরং, সন্তানের উচিত তাদের সঙ্গে সর্বদা বিনয়ী, সম্মানসূচক এবং মমতাময় আচরণ করা।
এছাড়া, সন্তানের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দোয়া হচ্ছে তাদের মা-বাবার দোয়া। মা-বাবা যে দোয়া করেন তা আল্লাহর কাছে অত্যন্ত সম্মানিত এবং গ্রহণযোগ্য। পবিত্র কোরআনে মা-বাবার জন্য সদাশয় থাকার পাশাপাশি তাদের দোয়া প্রার্থনা করার পরামর্শও রয়েছে।
হাদিসে মা-বাবার সঙ্গে সদাচার
হাদিসে মা-বাবার প্রতি সদাচারের গুরুত্ব এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য তা পালন করার আহ্বান আরও স্পষ্টভাবে এসেছে। আবদুল্লাহ বিন মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) একবার বলেছেন, “যথাসময়ে নামাজ পড়া, অতঃপর মা-বাবার সঙ্গে সদাচার এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করা—এই তিনটি কাজ আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয়।” (মুসলিম, হাদিস: ৫২৭) এখানে রাসুল (সা.) স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, নামাজের পর মা-বাবার সঙ্গে সদাচার একটি অন্যতম মহান আমল। এটা এমন একটি কাজ যা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য অপরিহার্য।
একইভাবে, আনাস বিন মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে রাসুল (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি চায় তার রিজিক প্রশস্ত হোক এবং আয়ু বৃদ্ধি পাক, সে যেন আত্মীয়দের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখে।” (বুখারি, হাদিস: ২০৬৭) এখানেও মা-বাবার প্রতি সদাচারের গুরুত্ব আলাদা করে তুলে ধরা হয়েছে। এক্ষেত্রে, আত্মীয়দের সঙ্গে সুসম্পর্ক শুধুমাত্র একটি সামাজিক কর্তব্য নয়, এটি জীবনে বরকত আনতে সাহায্য করে।
মা-বাবার দোয়ার গুরুত্ব
মা-বাবার দোয়া বিশেষ গুরুত্বের সাথে এসেছে ইসলামে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, “তিন ব্যক্তির দোয়া নিঃসন্দেহে কবুল হয়—মজলুমের দোয়া, মুসাফিরের দোয়া এবং সন্তানের জন্য বাবা-মায়ের দোয়া।” (ইবনে মাজাহ, হাদিস: ৩১২৯) মা-বাবার দোয়া যত শক্তিশালী এবং গ্রহণযোগ্য, তেমনি তাদের প্রতি শ্রদ্ধা এবং সদাচারও সন্তানের জীবনে অশেষ ফজিলত ও সাফল্য আনতে সাহায্য করে।
মা-বাবা তাদের সন্তানের প্রতি যে গভীর স্নেহ এবং মমতা দেখান, তাদের দোয়া সেই স্নেহের প্রভাব সহকারে সন্তানের জীবনে বরকত ও শান্তি নিয়ে আসে। এই দোয়াগুলি কখনোই মিথ্যা বা অপছন্দনীয় হয় না, বরং আল্লাহ তা তাত্ক্ষণিকভাবে গ্রহণ করেন। এ কারণে সন্তানের জন্য মা-বাবার দোয়া একটি অত্যন্ত প্রভাবশালী বিষয়, যা শুধু দুনিয়া নয়, পরকালেও সফলতা ও মুক্তির পথ খুলে দেয়।
অমুসলিম মা-বাবার সঙ্গে সদাচার
এমনকি যদি মা-বাবা অমুসলিম হন, তবুও ইসলামে তাদের সঙ্গে সদাচারের নির্দেশনা রয়েছে। সুরা লোকমান (আয়াত: ১৪-১৫) এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, “তোমার মা-বাবা যদি তোমাকে পীড়াপীড়ি করে আমার সঙ্গে কাউকে অংশীদার করতে, তুমি তাদের কথা মানবে না, তবে দুনিয়ায় তাদের সঙ্গে ন্যায়সংগতভাবে বসবাস কোরো…”।
এখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, যদিও মা-বাবা যদি ধর্মীয়ভাবে আল্লাহর সাথে শিরক করার প্রচেষ্টা চালান, তবুও তাদের প্রতি সদাচার প্রদর্শন করা হবে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, ইসলামে মা-বাবার প্রতি সদাচার কোনো শর্ত বা প্রেক্ষাপটের ওপর নির্ভরশীল নয়।
আসমা বিনতে আবু বকর (রা.)-এর একটি হাদিসে এ বিষয়টির সুস্পষ্ট প্রতিফলন পাওয়া যায়। তিনি বর্ণনা করেছেন, কুরাইশদের সময়ে তার মুশরিক মা তার কাছে আসতেন, এবং তিনি রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “হে আল্লাহর রাসুল, আমার মা আমার কাছে আসেন। আমি কি তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখব?” রাসুল (সা.) উত্তরে বলেন, “হ্যাঁ, তুমি তার সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখো।” (মুসলিম, হাদিস: ১০০৩)
এখানে রাসুল (সা.) অমুসলিম মা-বাবার সঙ্গেও সদাচারের গুরুত্ব তুলে ধরেছেন, যা আমাদের মাঝে একটি যুগোপযোগী বার্তা প্রদান করে।
মা-বাবার প্রতি অশ্রদ্ধার পরিণাম
ইসলামে মা-বাবার প্রতি অসম্মান প্রদর্শন বা দুর্ব্যবহার করা অত্যন্ত গুরুতর অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে রাসুল (সা.) বলেছেন, “ওই ব্যক্তি ধ্বংস হোক, ওই ব্যক্তি ধ্বংস হোক, ওই ব্যক্তি ধ্বংস হোক, যে ব্যক্তি বাবা ও মায়ের উভয়কে বা একজনকে বৃদ্ধাবস্থায় পেয়েছে, কিন্তু জান্নাতে প্রবেশ করতে পারেনি।” (মুসলিম, হাদিস: ২৫৫১)
এ হাদিসের মাধ্যমে রাসুল (সা.) স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন, মা-বাবার প্রতি অবজ্ঞা, অশ্রদ্ধা বা দুর্ব্যবহার করা শুধু ইহকালেই নয়, পরকালেও অত্যন্ত খারাপ পরিণতি ডেকে আনে। এই পরিণাম শুধুমাত্র এক আত্মবিধ্বংসী পথ নয়, এটি পরকালীন শাস্তির কারণও হতে পারে।
মা-বাবার সঙ্গে সদাচার শুধু এক ধর্মীয় দায়িত্ব নয়, এটি মানবিক সম্পর্কের শীর্ষে অবস্থান করে। ইসলাম মা-বাবার প্রতি শ্রদ্ধা এবং সম্মান প্রদর্শনের ক্ষেত্রে কোনো আপোষ বা ছাড় দেয় না। প্রতিটি মুসলমানের জন্য মা-বাবার প্রতি সর্বোচ্চ আদব ও সদাচার প্রদর্শন একটি অপরিহার্য কর্তব্য। কোরআন, হাদিস এবং ইসলামী জীবনধারা এ বিষয়ে একটি স্পষ্ট ও সুসংহত নির্দেশনা প্রদান করেছে, যা বর্তমান সমাজেও প্রাসঙ্গিক। সুতরাং, মা-বাবার প্রতি সদাচারের মাধ্যমে আমরা শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করি না, বরং আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনেও শান্তি, সাফল্য এবং বরকত আনতে সক্ষম হই।