আমীর হামযাহ
ইসলাম মানবজীবনের সর্বক্ষেত্রে সুষম ও ভারসাম্যপূর্ণ দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে। বিবাহ, সন্তান জন্মদান এবং পরিবার পরিকল্পনা এ সকল বিষয়ে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত স্পষ্ট। জন্মনিয়ন্ত্রণ এমন একটি বিষয়, যা অনেক ক্ষেত্রে পারিবারিক, সামাজিক এবং স্বাস্থ্যগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। তবে এর গ্রহণযোগ্যতা, সীমাবদ্ধতা ও শরীয়তের নির্ধারিত নীতিমালা সম্পর্কে সচেতন হওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন। এই প্রবন্ধে আমরা ইসলামের আলোকে জন্মনিয়ন্ত্রণের বিধান, এর উদ্দেশ্য ও প্রাসঙ্গিক দিকগুলো বিশদভাবে আলোচনা করব।
জন্মনিয়ন্ত্রণ: ইসলামের মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি
ইসলামের দৃষ্টিতে সন্তান জন্মদান বিবাহের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। এটি মানব প্রজাতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখার মাধ্যম। আল্লাহ তাআলা বলেন:
“তোমাদের জন্য তোমাদের স্ত্রীদের মধ্য থেকে সঙ্গী সৃষ্টি করেছেন এবং তাদের থেকে তোমাদের জন্য সন্তান-সন্ততি ও বংশধর সৃষ্টি করেছেন।” (সূরা আন-নাহল: ৭২)
সন্তান জন্মদান ও লালন-পালনের মাধ্যমে সমাজ গঠন ও মানবিক উন্নয়ন সাধন ইসলামের একটি মৌলিক উদ্দেশ্য। তবে, সন্তান গ্রহণের বিষয়ে ইসলামে কোনো বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়নি।
জন্মনিয়ন্ত্রণের বৈধতা ও প্রমাণ
জন্মনিয়ন্ত্রণের বৈধতার বিষয়ে ইসলামিক শরীয়তের দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। হাদিস শরিফে উল্লেখ আছে যে সাহাবিগণ নিরোধ পদ্ধতি (আযল) ব্যবহার করতেন। যেমন, জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) বলেন:
“আমরা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সময় নিরোধ করতাম এবং কুরআন নাজিল হচ্ছিল।” (সহীহ বুখারি: ৫২০৮; সহীহ মুসলিম: ১৪৪০)
এ থেকে বোঝা যায় যে, সন্তান নেওয়া বা না নেওয়ার বিষয়ে ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা শরীয়তে বৈধ। তবে এটি এমন হতে হবে যাতে স্বামী-স্ত্রীর উভয়ের সম্মতি থাকে এবং শরীয়তের কোনো সীমা লঙ্ঘিত না হয়।
জন্মনিয়ন্ত্রণের অনুমোদিত কারণ
ইসলামে কিছু নির্দিষ্ট প্রয়োজন ও অবস্থার ভিত্তিতে জন্মনিয়ন্ত্রণ বৈধ। নিম্নে এ সংক্রান্ত কিছু কারণ উল্লেখ করা হলো:
১. স্বাস্থ্যগত কারণ: যদি কোনো নারীর শারীরিক অবস্থা এমন হয় যে গর্ভধারণ করলে তার জীবন বিপন্ন হতে পারে, তবে জন্মনিয়ন্ত্রণ বৈধ। শাইখ ইবনে বাজ (রহ.) বলেন:
“যদি কোনো নারী অনেক সন্তান ধারণের কারণে দুর্বল হয়ে যায় এবং সেগুলো লালন-পালন কঠিন হয়ে পড়ে, তবে জন্মনিয়ন্ত্রণ বৈধ।” (ফাতাওয়া নূর আলা আদ-দারব: ২১/৩৯৪)
২. সন্তানদের যথাযথ লালন-পালন: যদি স্বামী-স্ত্রীর মনে হয় যে সন্তানদের যথাযথ লালন-পালন করা সম্ভব হবে না, তবে সন্তান নেওয়া বিলম্ব করা যেতে পারে।
জন্মনিয়ন্ত্রণের নিষিদ্ধ দিক
জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার কিছু পদ্ধতি ইসলামে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। যেমন:
১. অর্থনৈতিক কারণে: আল্লাহ তাআলা বলেন:
“তোমরা দারিদ্র্যের ভয়ে সন্তানদের হত্যা করো না। আমি তাদের এবং তোমাদের রিজিক দান করি।” (সূরা আল-ইসরা: ৩১)
তবে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক ভয়ের কারণে জন্মনিয়ন্ত্রণের সিদ্ধান্ত নেওয়া ইসলাম সমর্থন করে না। এ ক্ষেত্রে আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কুল করা উচিত।
২. স্থায়ী বন্ধ্যাত্ব: যদি কোনো ব্যক্তি স্থায়ীভাবে সন্তান জন্মদানের ক্ষমতা নষ্ট করে ফেলে, তা সম্পূর্ণরূপে হারাম। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন:
“তোমরা বিয়ে করো এবং বংশ বৃদ্ধি করো; কেননা আমি কিয়ামতের দিন তোমাদের সংখ্যাধিক্যে গর্ব করব।” (আবু দাউদ: ২০৫০)
৩. পশ্চিমা সংস্কৃতির অন্ধ অনুসরণ: অমুসলিমদের জীবনধারা ও সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে জন্মনিয়ন্ত্রণ করা ইসলাম অনুমোদন করে না। এটি মুসলিমদের আত্মপরিচয়ের বিপরীত।
ইসলামি ফিকহ কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত
ইসলামি ফিকহ কাউন্সিলের ১৯৮৮ সালের সিদ্ধান্তে জন্মনিয়ন্ত্রণ বিষয়ে কিছু নির্দেশনা প্রদান করা হয়। এতে উল্লেখ করা হয়:
১. স্বামী-স্ত্রীর সন্তান নেওয়ার স্বাধীনতা সীমিত করার জন্য কোনো সাধারণ আইন প্রণয়ন করা যাবে না। ২. চিরস্থায়ী জন্মনিয়ন্ত্রণ হারাম, তবে নির্দিষ্ট প্রয়োজন হলে তা অনুমোদিত। ৩. সন্তানের মাঝে সময়ের ব্যবধান রাখা বৈধ, যদি তা স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে হয় এবং শরীয়তের অন্য কোনো বিধান লঙ্ঘিত না হয়।