আমীর হামযাহ
বিবাহ মানবজীবনের এক অনন্য পবিত্র অধ্যায়। এটি শুধু দু’জন মানুষের মিলন নয়; বরং দুটি হৃদয়ের, দুটি পরিবারের এবং এক বৃহত্তর সমাজের মধ্যে একটি দায়িত্বপূর্ণ চুক্তি। ইসলাম বিবাহকে এমন এক মহান ইবাদত হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, যা জীবনের ভারসাম্য বজায় রাখে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের একটি উপায় হিসেবে কাজ করে।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন:
“তোমাদের মধ্য থেকে যারা বিবাহহীন, তাদের বিবাহ সম্পাদন করো। আর তোমাদের দাস ও দাসীদের মধ্যে যারা যোগ্য, তাদেরও। যদি তারা নিঃস্ব হয়, তবে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে অভাবমুক্ত করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।”
(সূরা নূর: ৩২)
বিবাহের মাধ্যমে মানুষের জীবনে আসে সুরক্ষা, প্রশান্তি এবং ভালোবাসার স্নিগ্ধতা। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“বিয়ে আমার সুন্নত। আর যে ব্যক্তি আমার সুন্নত থেকে বিমুখ হয়, সে আমার অনুসারী নয়।”
(সহিহ বুখারি: ৫০৬৩)
তবে বিবাহ শুধু একটি চুক্তি বা আনুষ্ঠানিকতা নয়; এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনের সূচনা। আর এই জীবনে সফলতার জন্য প্রয়োজন সঠিক প্রস্তুতি। ইসলাম এই প্রস্তুতিকে শুধু দুনিয়ার জন্য নয়, আখিরাতের জন্যও গুরুত্ব দিয়েছে। এই প্রবন্ধে আমরা ইসলামের আলোকে বিবাহের প্রস্তুতির বিস্তারিত দিকগুলো সুন্দরভাবে তুলে ধরব।
বিবাহের গুরুত্ব: ইসলামের আলোকে দৃষ্টিভঙ্গি
কুরআনের নির্দেশনা
আল্লাহ তাআলা বিবাহের গুরুত্ব সম্পর্কে বলেছেন:
“আর তার নিদর্শনসমূহের মধ্যে রয়েছে যে, তিনি তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের জন্য স্ত্রীগণকে সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের মাধ্যমে প্রশান্তি লাভ করতে পারো এবং তিনি তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও করুণা সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল লোকদের জন্য নিদর্শন রয়েছে।”
(সূরা রূম: ২১)
এই আয়াতটি বিবাহের মূল উদ্দেশ্যকে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে উপস্থাপন করে। স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে ভালোবাসা, দয়া এবং পারস্পরিক প্রশান্তির একটি গভীর বন্ধন গড়ে তোলে বিবাহ। এটি মানুষকে সামাজিক ও নৈতিক ভারসাম্যের পথে পরিচালিত করে।
হাদিসের দৃষ্টিতে বিবাহের গুরুত্ব
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন:
“তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি বিয়ের সামর্থ্য রাখে, সে যেন বিয়ে করে। কারণ, এটি দৃষ্টিকে সংযত রাখে এবং লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। আর যে ব্যক্তি বিয়ে করতে অক্ষম, সে যেন রোজা রাখে। এটি তার জন্য ঢালস্বরূপ।”
(সহিহ বুখারি: ৫০৬৫, সহিহ মুসলিম: ১৪০০)
এই হাদিসে রাসুল (সা.) বিয়েকে আত্মিক এবং শারীরিক সংযমের এক অনন্য পন্থা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। বিয়ে মানুষকে পাপ থেকে রক্ষা করে এবং তাকে একটি সংযত, শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবনের পথে পরিচালিত করে।
বিবাহের প্রস্তুতির মৌলিক স্তর
বিবাহের প্রস্তুতি এমন এক বিষয় যা কেবল ব্যক্তি নয়, তার পরিবার এবং বৃহত্তর সমাজেও প্রভাব ফেলে। ইসলামের দৃষ্টিতে বিবাহের প্রস্তুতি মূলত চারটি স্তরে বিভক্ত:
১. আত্মিক ও নৈতিক প্রস্তুতি
(ক) তাকওয়া অর্জন ও চরিত্র গঠন
তাকওয়া, অর্থাৎ আল্লাহভীতি, বিবাহের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি মানুষের চরিত্রকে শুদ্ধ করে এবং তাকে সৎপথে পরিচালিত করে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি উত্তম, যার চরিত্র সর্বোত্তম। আর যে ব্যক্তি তার পরিবারের প্রতি উত্তম আচরণ করে, সে প্রকৃত উত্তম।”
(তিরমিজি: ১১৬২)
চরিত্র গঠন মানে শুধু নিজেকে নৈতিকভাবে উন্নত করা নয়; এটি নিজের পরিবারের জন্য একজন আদর্শ মানুষ হওয়ার প্রচেষ্টাও।
(খ) ধৈর্যশীলতা ও দায়িত্ববোধ শেখা
বিবাহ মানেই নতুন দায়িত্ব। একটি পরিবার পরিচালনার জন্য ধৈর্যশীলতা এবং দায়িত্ববোধ অপরিহার্য। ইসলামের দৃষ্টিতে স্বামী-স্ত্রী দু’জনই একে অপরের প্রতি দায়িত্বশীল।
প্রসঙ্গ:
রাসুলুল্লাহ (সা.) ও উম্মুল মুমিনীন খাদিজা (রা.) এর সম্পর্ক একটি আদর্শ উদাহরণ। রাসুল (সা.) সবসময় তার স্ত্রীর প্রতি ধৈর্যশীল ও স্নেহময় ছিলেন।
২. আর্থিক প্রস্তুতি
(ক) হালাল উপার্জন নিশ্চিত করা
ইসলামে হালাল উপার্জন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“হালাল উপার্জন করা প্রত্যেক মুসলিমের ওপর ফরজ।”
(মুসনাদে আহমদ: ৮৫৮৩)
(খ) দেনমোহর নির্ধারণ
দেনমোহর স্ত্রীর একটি মৌলিক অধিকার, যা তাকে আর্থিক সুরক্ষা এবং মর্যাদা দেয়। কুরআনে আল্লাহ বলেন:
“তোমরা নারীদের তাদের মহর (পণ) স্বতঃস্ফূর্তভাবে দিয়ে দাও।”
(সূরা নিসা: ৪)
দেনমোহরের মাধ্যমে স্বামী স্ত্রীর প্রতি নিজের দায়িত্ব এবং ভালোবাসার প্রতিশ্রুতি প্রকাশ করে।
৩. শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি
(ক) শারীরিক পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্য
ইসলামে পবিত্রতা এবং পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“পবিত্রতা ঈমানের অর্ধেক।”
(সহিহ মুসলিম: ২২৩)
(খ) মানসিক প্রস্তুতি
বিবাহ একটি মানসিক বন্ধন। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভালোবাসা এবং বোঝাপড়া গড়ে তোলা একটি মানসিক প্রস্তুতির অংশ।
উদাহরণ:
রাসুলুল্লাহ (সা.) সবসময় তার স্ত্রীদের প্রতি দয়ালু এবং সহমর্মী ছিলেন। তিনি তাদের অনুভূতির প্রতি গভীর মনোযোগ দিতেন।
৪. জীবনসঙ্গী নির্বাচন
(ক) দ্বীনদারকে প্রাধান্য দেওয়া
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“নারীদের সঙ্গে বিবাহ চার কারণে সম্পাদিত হয়: তার সম্পদ, তার বংশ, তার সৌন্দর্য এবং তার দ্বীনদারি। তবে তোমরা দ্বীনদার নারীকে গ্রহণ করো। এতে তোমাদের কল্যাণ রয়েছে।”
(সহিহ বুখারি: ৫০৯০)
(খ) অভিভাবকের পরামর্শ
ইসলামে অভিভাবকের পরামর্শ বিবাহের জন্য অপরিহার্য। এটি ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে রক্ষা করে এবং সঠিক সিদ্ধান্তে সাহায্য করে।
৫. পারিবারিক ও সামাজিক প্রস্তুতি
(ক) পারিবারিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা
বিবাহ শুধুমাত্র দুটি মানুষের মিলন নয়; এটি দুই পরিবারের মধ্যেও সম্পর্ক তৈরি করে।
(খ) সামাজিক সম্পর্ক উন্নয়ন
বিবাহের মাধ্যমে সামাজিক সম্পর্কগুলো আরও দৃঢ় হয় এবং পারস্পরিক সমর্থন বৃদ্ধি পায়।
৬. ইসলামী বিধি-বিধান সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন
(ক) বিবাহের মৌলিক শর্ত
ইসলামে বিবাহের শর্তসমূহ হলো:
- সাক্ষী উপস্থিতি
- দেনমোহর নির্ধারণ
- অভিভাবকের অনুমতি
(খ) বিবাহ-পরবর্তী অধিকার ও দায়িত্ব
স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন হওয়া বিবাহ সফল করার একটি মূল বিষয়।
বিবাহ একটি পবিত্র ইবাদত যা শুধুমাত্র সামাজিক বন্ধন নয়, বরং এটি দাম্পত্য জীবনে প্রশান্তি ও আখিরাতের কল্যাণ বয়ে আনে। সঠিক প্রস্তুতি ছাড়া বিবাহের উদ্দেশ্য পূর্ণতা পায় না।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে সঠিকভাবে বিবাহের প্রস্তুতি গ্রহণ এবং জীবনের এই সুন্দর অধ্যায়ে সফলতা অর্জনের তাওফিক দিন। আমিন।