আমীর হামযাহ
পরিবার মানবজীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। এটি শুধুমাত্র একটি সামাজিক গঠনী নয়, বরং একজন ব্যক্তির চরিত্র, নৈতিকতা, ও আধ্যাত্মিক বিকাশের মূল ভিত্তি। ইসলামে পরিবারকে অত্যন্ত উচ্চ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা ঘর ও পরিবারকে তাঁর অন্যতম দান হিসেবে উল্লেখ করেছেন। সুরা নাহলের ৪০ নম্বর আয়াতে তিনি বলেন, “আল্লাহ তোমাদের ঘরকে করেছেন তোমাদের আবাসস্থল।” এর মাধ্যমে স্পষ্ট হয় যে, পরিবারই হলো মানুষের প্রকৃত আশ্রয়স্থল, যেখানে সে সুরক্ষা, শিক্ষা, এবং ভালবাসার অনুভূতি লাভ করে।
আদর্শ মুসলিম পরিবারের মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ
ইসলামে আদর্শ পরিবার গঠনের জন্য কয়েকটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এগুলো কেবলমাত্র কোরআন ও হাদিসে বর্ণিত নয়, বরং এগুলো বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করার মাধ্যমে একটি সুসংহত ও সুন্দর পরিবার গঠন সম্ভব। নিচের আলোচনায় একটি আদর্শ পরিবারের রূপরেখা তুলে ধরা হল।
১. আদর্শ স্ত্রী নির্বাচন
আদর্শ পরিবার গঠনের প্রথম শর্ত হলো আদর্শ স্ত্রীর নির্বাচন। কোরআনের সুরা নুরের ৩২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “তোমাদের মধ্যে যারা ‘আইয়িম’ (স্বামীহীন নারী) তাদের বিয়ে করো এবং তোমাদের দাস-দাসীর মধ্যে যারা সৎ তাদেরও।” এছাড়া রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, “তোমরা চার গুণ দেখে মেয়েদের বিয়ে করো: তার সম্পদের জন্য, তার বংশ পরিচয়ের জন্য, তার সৌন্দর্যের জন্য ও তার ধার্মিকতার জন্য। অতঃপর তুমি ধার্মিকতাকে অগ্রাধিকার দাও। নতুবা তুমি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫০৯০) এই নির্দেশনা অনুসারে, একজন মুসলিমকে স্ত্রীর বাছাই করার সময় তার ধর্মীয়তা, চরিত্র, এবং বংশ পরিচয়কে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে।
২. দ্বিনের চর্চা
আদর্শ মুসলিম পরিবারে ধর্মীয় চর্চা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে ধর্মীয় জ্ঞান ও অনুশাসন, আল্লাহর বিধি-বিধানের প্রতিপালন, কোরআন তিলাওয়াত ও জিকির এবং সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধের চর্চা থাকবে। কুরআনের সুরা ইউনুসের ৮৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, “আমি মুসা ও তার ভাইয়ের প্রতি প্রত্যাদেশ দিলাম—মিসরে তোমার সম্প্রদায়ের জন্য ঘর নির্মাণ করো। তোমাদের ঘরগুলোকে ‘ইবাদতখানা’ করো, তোমরা নামাজ কায়েম করো এবং মুমিনদের সুসংবাদ দাও।” (সুরা ইউনুস, আয়াত: ৮৭) এই আয়াতের মাধ্যমে স্পষ্ট হয় যে, পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে ধর্মীয় শিক্ষা ও চর্চার মাধ্যমে আল্লাহর নিকটতা অর্জন করতে হবে।
৩. ধর্মীয় শিক্ষা নিশ্চিত করা
আদর্শ মুসলিম পরিবার তাদের সন্তানদের ইসলামী শিক্ষা প্রদান করবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, “(ইসলামী) জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ফরজ।” (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস: ২২৪) ইসলামী শিক্ষা শুধুমাত্র ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং পরিবারে নিজে থেকেই একটি সমৃদ্ধ পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করা উচিত, যেখানে কোরআন, হাদিস, ইসলামী সাহিত্য ও ইতিহাস-ঐতিহ্যবিষয়ক বই থাকবে। শিশুদেরকে নিয়মিত ইসলামী সাহিত্য পাঠ করানো উচিত, যা তাদেরকে ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস ও বিধি-বিধানের প্রতি গভীর আকর্ষণ জাগাবে।
৪. পারস্পরিক জবাবদিহি
আদর্শ মুসলিম পরিবারে পারস্পরিক জবাবদিহি একটি অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য। কুরআনের সুরা আশ-শুয়ারার ২১৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, “আপনি আপনার নিকটাত্মীয়দের সতর্ক করুন।” এর মাধ্যমে বোঝা যায়, পরিবারের সদস্যদের মধ্যে পরামর্শ, সহযোগিতা, জবাবদিহি ও সতর্কীকরণের মাধ্যমে নিজেদের সুপথে পরিচালিত করতে হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর পরিবারকে সতর্ক করে বলেন, “তোমরা নিজেদের জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করো।” (তাফসিরে ইবনে কাসির) এই নির্দেশনা অনুসারে, পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে একে অপরের সাথে সহযোগিতা ও পরামর্শের মাধ্যমে সঠিক পথে পরিচালিত করতে হবে।
৫. পাপ ও পাপ উপকরণমুক্ত হওয়া
আদর্শ মুসলিম পরিবারে পাপ ও পাপের উপকরণ থেকে মুক্ত থাকা অত্যন্ত জরুরি। পাপের উপকরণ পাপ কাজে উৎসাহিত করে এবং পাপ পারিবারিক শৃঙ্খলা ও শান্তি নষ্ট করে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, “সৎ সঙ্গী ও অসৎ সঙ্গীর দৃষ্টান্ত আতর বিক্রেতা ও কামারের হাপরের মতো।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ২১০১) এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, পাপের উপকরণ থেকে দূরে থাকা ও ভালো উপকরণের মন্দ ব্যবহার থেকে বিরত থাকা প্রয়োজন।
৬. সময়ের শৃঙ্খলা
আদর্শ মুসলিম পরিবারে সময়ের শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য। কুরআনের সুরা বাকারা ২৩৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, “তোমরা নামাজের প্রতি যত্নবান হও, বিশেষত মধ্যবর্তী নামাজের এবং আল্লাহর উদ্দেশে তোমরা বিনীত হয়ে দাঁড়াও।” এছাড়া রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, “কিয়ামতের দিন কোনো বান্দা সামনে অগ্রসর হতে পারবে না, যতক্ষণ না তাকে জিজ্ঞেস করা হবে, সে জীবন (সময়) কোথায় ব্যয় করেছে, জ্ঞান কী কাজে লাগিয়েছে, সম্পদ কোথা থেকে উপার্জন করেছে ও কোথায় ব্যয় করেছে এবং শরীর কোথায় উন্মুক্ত করেছে।” (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ২৪১৭) এর ফলে স্পষ্ট হয়, পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে তাদের সময় সঠিকভাবে ব্যবহারের দিকে মনোযোগী হতে হবে।
৭. গোপনীয়তা রক্ষা
পারিবারিক গোপনীয়তা রক্ষা করা আদর্শ মুসলিম পরিবারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কুরআনের সুরা নিসা ৩৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “তাদের উভয়ের মধ্যে বিরোধের আশঙ্কা করলে তোমরা তার (স্বামী) পরিবার থেকে একজন ও তার (স্ত্রী) পরিবার থেকে একজন সালিস নিযুক্ত করবে।” এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, পারিবারিক সংকট সমাধানে গোপনীয়তা রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, “অবস্থানের দিক থেকে আল্লাহর কাছে নিকৃষ্ট মানুষ হলো যে স্বামী তার স্ত্রীর কাছে যায় এবং যে স্ত্রী তার স্বামীর কাছে যায়, অতএপর সেই গোপনীয়তা প্রকাশ করে দেয়।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৪৩৭) এর ফলে স্পষ্ট হয়, পরিবারের মধ্যে গোপনীয়তা রক্ষা করা ও নিজেদের মধ্যে সমস্যা সমাধান করা উচিত।
৮. পরস্পরকে সহযোগিতা
সাংসারিক কাজে পরিবারের সদস্যরা পরস্পরকে সহযোগিতা করবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, “আল্লাহ যখন কোনো পরিবারের কল্যাণ চান, তখন তাতে মমতা ও ভালোবাসা দান করেন।” (মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ১৫৯৩) এর মাধ্যমে বোঝা যায়, পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে একে অপরের সহায়তায় কাজ করতে হবে, যাতে পরিবারটি সুস্থ ও সুখী হয়।
৯. পর্দা ও শালীনতা
ইসলামে নারী-পুরুষ উভয়কে শালীনভাবে চলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কুরআনের সুরা আহজাব ৩৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “তোমরা ঘরে অবস্থান করো এবং জাহেলি (বর্বর) যুগের মতো নিজেদের প্রদর্শন করো না।” এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, নারীদের শালীন পোশাক ও শালীন চলন বজায় রাখতে হবে, শুধুমাত্র বাইরে নয় বরং ঘরেও শালীনভাবে থাকা প্রয়োজন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, “মুসলমানরা নিজেদের মধ্যে শালীনতা বজায় রাখুক, যাতে তাদের চরিত্র উন্নত হয়।”
পরিবারের মধ্যে মায়ের গুরুত্ব
আদর্শ ইসলামী পরিবার গঠনে মায়ের ভূমিকা অপরিহার্য। একজন মায়ের পূর্ণ সহযোগিতা ছাড়া পরিবারের সফলতা অর্জন অসম্ভব। শাইখুল ইসলাম মুফতি মুহাম্মাদ তাক্বী উসমানীর সহধর্মিণীর সাক্ষাৎকার থেকে বোঝা যায়, মায়ের সমর্থন ও সহযোগিতা মুফতী সাহেবের ইসলামী খেদমতে সফলতা অর্জনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। তিনি বলেন, “বিয়ের প্রথম দিনই আমি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলাম ঘরের কাজকর্ম এমনভাবে সামলাব যাতে আমার স্বামী তাঁর সবটুকু সময় দ্বীনের তরক্কী ও ইশা‘আতের (প্রচার-প্রসারের) কাজে ব্যয় করতে পারেন।” এই উদাহরণ থেকে স্পষ্ট হয়, মায়ের সহায়তা ও পরিশ্রমের ফলে একজন স্বামী তার ধর্মীয় দায়িত্ব পালনে সম্পূর্ণ মনোযোগ দিতে পারেন।
কোরআন ও হাদিসের নির্দেশনা
ইসলামে পরিবারের গঠন ও পরিচালনায় কোরআন ও হাদিসের নির্দেশনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন আয়াত ও হাদিসে পরিবারের সদস্যদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
- সুরা লোকমান ১৩-১৯ আয়াত: এখানে লোকমান তার পুত্রকে আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক না করার উপদেশ দেন এবং পিতামাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করার গুরুত্ব তুলে ধরেন। এই আয়াতগুলি পরিবারে সমবেদনা ও সম্মান বজায় রাখার নির্দেশনা প্রদান করে।
- সুরা ইবরাহীম ৩৯-৪১ আয়াত: এখানে আল্লাহ তার সন্তানের প্রতি সদয়তা ও ক্ষমার অনুরোধ করেছেন। এটি পরিবারের মধ্যে করুণা ও সহানুভূতির গুরুত্ব প্রকাশ করে।
- সুরা আল-আহকাফ ১৫-১৬ আয়াত: আল্লাহ তার সন্তানদেরকে দীনদারী ও সতকর্মে উৎসাহিত করেন, যা একটি আদর্শ পরিবারের মূল ভিত্তি।
- হাদিস: রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, “তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে পরিপূর্ণ মুমিন ঐ ব্যক্তি, যে তোমাদের মধ্যে উত্তম চরিত্রবান এবং তার পরিবারের প্রতি দয়াবান।” এছাড়া, অন্যান্য হাদিসে পরিবারে দায়িত্বশীলতা, সহানুভূতি ও সহায়তার গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে।
চ্যালেঞ্জসমূহ ও সমাধান
আধুনিক সমাজে পাশ্চাত্য কৃষ্টি-কালচারের আগ্রাসন, অনৈসলামী প্রথা, দুর্নীতি, এবং তালাকের প্রবণতা বেড়ে চলেছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ইসলামে নির্দেশিত পথগুলো অনুসরণ করা প্রয়োজন। নারীদের জন্য দ্বীনী মাহফিলের আয়োজন, ধার্মীয় শিক্ষা ও আদর্শ মায়ের গুরুত্বকে সামনে রেখে পরিবারকে সুসংহত রাখা এই সমস্যাগুলোর সমাধানে কার্যকর ভূমিকা রাখবে ইনশাআল্লাহ।
ইসলামে পরিবারকে অত্যন্ত উচ্চ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। আদর্শ মুসলিম পরিবারের রূপরেখা কোরআন ও হাদিসের মাধ্যমে সুস্পষ্টভাবে নির্ধারিত হয়েছে। আদর্শ স্ত্রীর নির্বাচন, দ্বিনের চর্চা, ধর্মীয় শিক্ষা, পারস্পরিক জবাবদিহি, পাপমুক্ত থাকা, সময়ের শৃঙ্খলা, গোপনীয়তা রক্ষা, পরস্পরকে সহযোগিতা, এবং পর্দা ও শালীনতা এসব মূলনীতি মেনে চললে একজন মুসলিম পরিবারের সদস্য হিসেবে সফলভাবে জীবনযাপন করতে পারেন। মায়ের ভূমিকা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, যিনি পরিবারের শৃঙ্খলা বজায় রাখতে ও সংসারের সুস্থতা নিশ্চিত করতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। এই আদর্শ গঠন অনুসরণ করলে পরিবার একটি শক্তিশালী ভিত্তি হয়ে উঠবে, যা সমাজের উন্নতি ও শান্তির প্রতীক হিসেবে কাজ করবে।