আমীর হামযাহ
পরিবার একটি সমাজের মৌলিক অবকাঠামো। এর গুরুত্ব কখনও কমে না। একদিকে এটি যেমন সমাজের ভিত্তিপ্রস্তর, তেমনি অন্যদিকে একটি জীবনধারা। যেখানে সম্পর্ক, ভালোবাসা, দায়িত্ব এবং সহানুভূতির মধ্যে অদৃশ্য এক বন্ধন গড়ে ওঠে। আমাদের সমাজের কাঠামো এবং সভ্যতা চিরকালিকভাবে পরিবারের উপর নির্ভরশীল। কারণ এটি শুধুমাত্র ব্যক্তিগত প্রয়োজন পূরণে সহায়তা করে না; বরং সামাজিক, মানসিক, এবং আধ্যাত্মিক দিক থেকেও সুরক্ষা প্রদান করে। তবে, আজকের যুগে, বিশেষ করে একবিংশ শতাব্দীতে, পরিবারকে এমন একটি বিশাল চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হচ্ছে, যার মোকাবিলা করা সচেতনতার দাবি রাখে। পরিবর্তিত সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে, পরিবারের গঠন, ভূমিকা, ও কার্যক্রমে অসংখ্য পরিবর্তন ঘটেছে।
পরিবারের কাঠামো: অতীত থেকে বর্তমান
একসময় পরিবারের সদস্যরা কেবল নিজেরাই নয়, বরং আত্মীয়-স্বজন, পিতামাতা এবং তাদের বংশধরদের সমন্বয়ে একটি বৃহৎ পরিবার গঠন করত। তখনকার পরিবার ছিল এক অর্থে একটি ছোট সমাজের মতো, যেখানে সবাই একে অপরের সঙ্গে মেলামেশা করে, সুখ-দুঃখ ভাগ করে একে অপরকে সহায়তা করত। একটি বৃহৎ পরিবার ছিল আত্মবিশ্বাসের, সামাজিক নিরাপত্তার এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি শক্তিশালী আধার। এ পদ্ধতি এখনো বিশ্বের কিছু কিছু আঞ্চলে রক্ষিত আছে।
কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, বিশেষত শহুরে জীবনযাত্রার আধিপত্য বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক চাপ, এবং আধুনিকতা ছোঁয়ায়, বৃহৎ পরিবারের ধারণা সঙ্কুচিত হয়ে ছোট পরিবারে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। এখনকার পরিবারগুলো সাধারণত মা-বাবা, স্বামী-স্ত্রী ও তাদের সন্তানদের নিয়ে গঠিত। অনেক ক্ষেত্রে আরো সঙ্কুচিত, শুধু স্বামী-স্ত্রী ও তাদের সন্তানদের নিয়ে গঠিত। যদিও এই পরিবর্তন সারা পৃথিবীতেই ঘটেছে, তবে এটি আমাদের সমাজের জন্য একটি বড় ধরনের সংস্কার হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিবারের শৃঙ্খলা, দায়িত্ববোধ, সম্পর্ক এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য একে অপরের সাথে মিশে গিয়েছিল, যা এখন অনেক ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ এবং পরিবারের পুনর্গঠন
একটি পরিবারের আর্থিক অবস্থা বর্তমানে তার সামগ্রিক কাঠামো এবং স্থিতিশীলতার জন্য সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতীতে, এক বড় পরিবারের সদস্যরা একে অপরকে আর্থিকভাবে সহায়তা করত এবং সামগ্রিকভাবে জীবনযাপন করত। পরিবারগুলো তখন ছিল এক ধরনের সমবায়ের কেন্দ্র, যেখানে সবাই নিজের দায়িত্ব পালনে একে অপরকে সাহায্য করত। কিন্তু আজকের দিনে, বিশ্বায়ন, আধুনিক ব্যবসা এবং চাকরির খোঁজে মানুষ শহরের দিকে ছুটে যাচ্ছে, যার ফলে গ্রামের পরিবারগুলোও কমে যাচ্ছে এবং শহুরে পরিবারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখনকার অর্থনৈতিক অবস্থা অনেকটাই পাল্টে গেছে।
আজকাল, অনেক ক্ষেত্রেই স্বামী-স্ত্রী দুজনেই কাজ করছেন জীবিকা নির্বাহের জন্য। তাদের দুজনেরই কাজের চাপ এবং সামাজিক দায়িত্বের বোঝা এতটাই বেড়েছে যে, পরিবারে ব্যক্তিগত সময় এবং সম্পর্কের জন্য খুব কম জায়গা রয়ে গেছে। একদিকে যেমন পরিবারের আর্থিক চাহিদা পূরণের জন্য দুজনকেই কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়, তেমনি অন্যদিকে সন্তানদের জন্য যথাযথ শিক্ষা, আদর্শ, ও মনোযোগ দেওয়ার সময় সংকট তৈরি হচ্ছে। এটি একটি বড় ধরনের সংকট, কারণ শিশুরা এমন সময় কাটাচ্ছে, যখন তাদের সবচেয়ে বেশি মনোযোগ এবং স্নেহের প্রয়োজন। এই চ্যালেঞ্জটি বর্তমানে প্রায় সকল পরিবারে প্রভাব ফেলছে এবং দিন দিন এটি বেড়েই চলেছে।
প্রযুক্তির প্রভাব এবং পরিবারে বিচ্ছিন্নতা
একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় পরিবর্তনগুলির মধ্যে একটি হলো প্রযুক্তির উত্থান। সামাজিক মাধ্যম, স্মার্টফোন, ইন্টারনেট এবং অন্যান্য ডিজিটাল প্রযুক্তির কারণে যোগাযোগের নতুন পথ খুলে গেছে। তবে এই প্রযুক্তির অত্যধিক ব্যবহার পরিবারের মধ্যে সম্পর্কের মান কমিয়ে দিয়েছে। এক সময় যেখানে পরিবার সদস্যরা একে অপরের সাথে মুখোমুখি বসে গল্প করত, সময় কাটাত, সেখানে এখন তা একেবারেই কমে গেছে। বিশেষ করে, বাবা-মা যেহেতু কর্মব্যস্ত, তারা নিজেদের কাজ এবং ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে এতটাই ব্যস্ত যে, তাদের সন্তানদের সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য সময় বের করতে পারছেন না। এর ফলে পরিবারে আন্তঃসম্পর্কে অবহেলা এবং সম্পর্কের মধ্যে দুরত্ব তৈরি হচ্ছে।
এছাড়া, প্রযুক্তি এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মাধ্যমে সহজেই সম্পর্ক স্থাপন করা সম্ভব হয়ে উঠেছে, যা পারিবারিক ও দাম্পত্য জীবনকে বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে। আজকাল, এক ক্লিকেই মানুষ যেকোনো জায়গার মানুষের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে, এবং এটি অনেক ক্ষেত্রে বিবাহিত জীবনকে ঝুকিতে ফেলে দেয়। এটি দাম্পত্য জীবনে বিশ্বাসের অভাব সৃষ্টি করে, যার ফলে পারিবারিক বন্ধন আরও দুর্বল হয়ে পড়ছে।
মিডিয়ার প্রভাব এবং সৌন্দর্যের মান
সৌন্দর্যের যে মান সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা এখন ভীষণভাবে পরিবর্তিত হয়েছে এবং বিশেষত, এটি মিডিয়া এবং বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে। সুন্দর এবং আকর্ষণীয় দেখতে পাওয়ার জন্য নারী-পুরুষদের ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। নারীরা বিশেষভাবে তাদের দেহের সৌন্দর্য ও বাহ্যিক চেহারা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছেন, যার ফলে শারীরিক ও মানসিক দিক দিয়ে তাদের ওপর এক ধরনের অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। বিউটি পার্লার, প্রসাধনী, ফিটনেস রুটিন—এই সব কিছু যেন এখন অনেক সমাজেই একজন নারীর জীবনের অপরিহার্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এমনকি, পিতা-মাতা তাদের সন্তানদের দেহ ও বাহ্যিক সৌন্দর্যকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিতে গিয়ে তাদের মানসিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা নিয়ে অবহেলা করছেন। এমন পরিস্থিতিতে, একটি পরিবারে শৃঙ্খলা, সম্পর্ক এবং ভালোবাসার মূল্য আরও কমে যাচ্ছে, যা প্রজন্মের পর প্রজন্মে সমস্যা তৈরি করছে। সামাজিক মিডিয়ার সৌন্দর্য সম্পর্কিত স্ট্যান্ডার্ডগুলো এমনকি দাম্পত্য জীবনে সম্পর্কের উপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, কারণ পুরুষরা তাদের স্ত্রীর সৌন্দর্য নিয়ে অনবরত অসন্তুষ্ট থাকছেন, এবং নারীরা নিজেদের সৌন্দর্য নিয়ে অধিক সময় ও মনোযোগ দিতে বাধ্য হচ্ছেন।
পরিবর্তিত ভূমিকা এবং সামাজিক চাপ
আধুনিক সমাজে নারীও পুরুষের সঙ্গে সমানভাবে জীবনযাপন করছে। তবে, এতে একটি নতুন চাপ তৈরি হয়েছে। নারীরা এখন কর্মজীবী হয়ে ওঠায় তাদের উপর শারীরিক সৌন্দর্য, সন্তান পালন, এবং পরিবারের অন্যান্য দায়িত্ব পালন করার দ্বিগুণ চাপ সৃষ্টি হয়েছে। এটি সামাজিকভাবে প্রচলিত পুরোনো ধারণার সাথে একেবারেই বিপরীত। অতীতে, নারীরা এই সব দায়িত্ব পালন করতে বাধ্য ছিল না; কিন্তু এখন তাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং পেশাগত জীবন সমানভাবে ব্যালেন্স করতে হচ্ছে, যার ফলে তারা মানসিক ও শারীরিকভাবে একাধিক চাপ অনুভব করছেন।
ভবিষ্যতের পরিবার : এক নজরে কিছু আশা এবং সংকট
ভবিষ্যতের পরিবার: আশা এবং সংকট এই সমস্ত চ্যালেঞ্জের মধ্যে, ভবিষ্যতের পরিবার কীভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে, তা নির্ভর করছে আমাদের সমাজের সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং মূল্যবোধের ওপর। পরিবার যদি তার মূল ভিত্তি, আস্থা, ভালোবাসা এবং দায়িত্ববোধ বজায় রাখতে পারে, তবে এইসব চ্যালেঞ্জের মধ্যেও পরিবার টেকসই ও স্থিতিশীল থাকতে পারবে। তবে, যদি পরিবারে সম্পর্কের গুরুত্ব কমে যায় এবং সদস্যরা একে অপরের প্রতি দায়িত্ব পালন না করে, তবে তা সমাজের জন্য এক বড় ধরনের বিপদ হয়ে উঠবে।
আশা:
১. নতুন যোগাযোগের পথ
প্রযুক্তির উন্নতি, বিশেষত ইন্টারনেট এবং সামাজিক মিডিয়ার মাধ্যমে, পরিবারগুলো তাদের সদস্যদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন এবং গভীর যোগাযোগ রক্ষা করতে সক্ষম হচ্ছে। দূরত্ব থাকলেও, ভিডিও কল এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সহজেই পরিবারের সদস্যরা একে অপরের কাছে পৌঁছাতে পারছেন, যা সম্পর্কের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি করছে।
২. আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কিং এবং সমন্বয়
বিশ্বায়নের ফলে পরিবারগুলো পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়লেও, তারা ডিজিটাল মাধ্যমে একে অপরের সাথে যোগাযোগ বজায় রাখতে পারছে। এটি তাদের সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করেছে এবং দূরে থেকে কিছুটা হলেও সমন্বিত জীবনযাপন সম্ভব করে তুলেছে।
৩. নারীর যৌক্তিক অধিকার বাস্তাবায়ন
বর্তমানে অনেক ক্ষেত্রেই নারীরা পুরুষদের সঙ্গে সমানভাবে পারিবারিক এবং পেশাগত দায়িত্ব পালন করছেন। নারীশক্তির এই উত্থান সমাজের জন্য খুব ভাল লক্ষণ নয়। আপাত দৃষ্টিতে এটি ভাল মনে হলেও পারিবারিক অস্থিরতার এটি অন্যতম কারন। তাই নরিকে তার যথাযথ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠত করেতে হবে। অবশ্য আশার বিষয় হলো অনেক সমাজে ইতো মধেই এনিয়ে সচেতনতা শুরু হয়েছে।
৪. মানসিক স্থিতিশীল ও সুস্থতার গুরুত্ব বৃদ্ধি
আজকের সমাজে মানসিক সুস্থতা একটি অপরিহার্য বিষয় হয়ে উঠেছে, বিশেষ করে পরিবারে। শারীরিক স্বাস্থ্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি মানসিক ও আবেগিক সুস্থতার প্রতি সচেতনতা ও যত্ন বাড়ানোও অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। পরিবারগুলো এখন একে অপরের মানসিক অবস্থার প্রতি অধিক মনোযোগী এবং সহানুভূতিশীল হচ্ছে, যার ফলে সম্পর্ক আরও মধুর ও গভীর হচ্ছে। বর্তমান সময়ে অনেক পরিবার মানসিক সুস্থতা সংক্রান্ত সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি, প্রয়োজনীয় পরামর্শ এবং কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। এর ফলে, পারিবারিক বন্ধন আরও দৃঢ় হচ্ছে, এবং একে অপরকে মানসিক ও আবেগিকভাবে ভালোভাবে বুঝে সহায়তা প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে।
৫. সামাজিক সম্প্রীতি ও পারস্পরিক সহায়তা
অনেক ক্ষেত্রেই পরিবারে সদস্যরা একে অপরকে সহায়তা ও সমর্থন দিচ্ছে। বিশেষ করে, দাম্পত্য জীবন এবং পরিবারে সন্তানের মানসিক, শারীরিক এবং আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য সহানুভূতিশীল মনোভাব বড় একটি আশার বার্তা।
৬. পরিবর্তিত সামাজিক রীতিনীতি এবং আইনগত পরিবর্তন
আজকের সমাজে, বিশেষত উন্নত দেশে, পরিবার এবং দাম্পত্য জীবন নিয়ে আইনগত সুরক্ষা বৃদ্ধি পেয়েছে। বাচ্চাদের মধ্যে পারস্পরিক কাজে অংশগ্রহণ এবং পরিবারের সিদ্ধান্তে অংশগ্রহণের সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। তারা একে অপরের জন্য কাজ করতে শিখছে। যা পারিবারিক বন্ধন গাড় হওয়া আশা যোগায়।
সংকট:
১. পারিবারিক সম্পর্কের দুর্বলতা
টেকসই সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য পরিবারের সদস্যদের মাঝে পর্যাপ্ত সময় এবং মানসিক যোগাযোগের অভাব বাড়ছে। বিশেষত কর্মজীবী অভিভাবকরা সন্তানের প্রতি সময় দিতে না পারায়, সম্পর্কের মধ্যে স্নেহের অভাব দেখা যাচ্ছে।
২. অর্থনৈতিক চাপ ও জীবনযাত্রার পরিবর্তন
একাধিক কাজের চাপ, ঋণের বোঝা এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে পারিবারিক জীবন কঠিন হয়ে পড়ছে। পরিবারের সদস্যদের মাঝে আর্থিক দিক থেকে ভারসাম্য বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে, যা মানসিক চাপের সৃষ্টি করছে।
৩. টেকসই সম্পর্কের অভাব
বিশ্বায়ন এবং সামাজিক মিডিয়ার প্রভাবের কারণে দাম্পত্য জীবনে সম্পর্কের অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হচ্ছে। এক ক্লিকেই নতুন সম্পর্ক গড়ে তোলা, এটি দাম্পত্য জীবনে বিশ্বাসের অভাব সৃষ্টি করছে, যার ফলস্বরূপ সম্পর্কের স্থিতিশীলতা বিপন্ন হচ্ছে।
৪. সামাজিক মিডিয়ার অপব্যবহার
সামাজিক মাধ্যমের মাধ্যমে বাহ্যিক সৌন্দর্য এবং সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, যা ব্যক্তিগত জীবনে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করছে। পরিবারে সদস্যদের দেহ ও গৃহসামগ্রীর সৌন্দর্য নিয়ে অসন্তুষ্টি, বিশেষ করে দাম্পত্য জীবনে, সম্পর্কের মধ্যে খারাপ প্রভাব ফেলছে।
৫. মূল্যবোধের প্রতি যত্নের অভাব
পারিবারিক ঐতিহ্য, সম্পর্ক এবং মূল্যবোধের প্রতি যত্নের অভাব এবং আধুনিক প্রযুক্তির প্রভাবের কারণে, কিছু পরিবারে শৃঙ্খলার অভাব দেখা দিয়েছে। বিশেষত দাম্পত্য জীবনে, যেখানে আত্মবিশ্বাস এবং সহানুভূতির অভাব বিরাজ করছে।
৬. পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা
তিন বা তার বেশি প্রজন্মের পরিবারগুলোর মধ্যে সম্পর্কের দুরত্ব বেড়েছে। অনেক পরিবারে একই প্রজন্মের সদস্যদের মাঝে সহানুভূতি ও বন্ধন দুর্বল দুর্বল হয়ে পড়েছে। যা ভবিষ্যতের জন্য অশনি সঙ্কেত।
একনজরে কিছু করনীয় ও বর্জনীয়
করণীয়:
১. পারিবারিক সম্পর্ক মজবুতকরণ
এবিষয়টি অত্যন্ত জরুরি, পরিবারের সদস্যরা যেন একে অপরের সঙ্গে অটুট যোগাযোগ রাখে। তাদের জীবনের ঘটনাগুলির প্রতি সহানুভূতি ও মনোযোগ প্রদানের মাধ্যমে সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করা যেতে পারে।
২. কর্মজীবী অভিভাবকদের জন্য সময় ব্যবস্থাপনা
অভিভাবকদের অবশ্যই তাদের কর্ম এবং পারিবারিক জীবনের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। সন্তান ও পিতা-মাতার প্রতি সময় দেওয়ার জন্য বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে।
৩. সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মার্জিত ব্যবহার
সামাজিক মিডিয়ার ব্যবহার সীমিত করতে হবে। পারিবারিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রয়োজনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সময় কাটানো এবং সম্পর্ক স্থাপন করার ক্ষেত্রে যৌক্তিক বিধিনিষেধ মেনে বিকল্প নেই।
৪. আত্মিক ও স্বাস্থ্যগত সচেতনতা বৃদ্ধি
পারিবারিক সদস্যদের মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি। প্রয়োজনে কাউন্সেলিং বা সহায়তার ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। হতে পারে সমন্বিত আলোচনা ও পর্যলোচনা।
৫. অর্থনৈতিক পরিকল্পনা এবং সমন্বয়
পরিবারের আর্থিক অবস্থা উন্নত করার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা তৈরি করা উচিত। পরিমিত ব্যয় এর মাধ্যমে অর্থনৈতিক চাপ কমিয়ে আনা এবং সদস্যদের মধ্যে সহযোগিতামূলক আচরণ তৈরি করা অপরিহার্য।
৬. পারিবারিক মূল্যবোধের শিক্ষা
সন্তানদের মধ্যে পারিবারিক মূল্যবোধের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করা এবং তাদের শৃঙ্খলা, দায়িত্ববোধ এবং সৎ চরিত্র গঠনে সহায়তা করা।
৭. নারী ও পুরুষের মধ্যে দায়িত্ব ভাগাভাগি
নারী ও পুরুষের মধ্যে কাজ এবং দায়িত্ব যৌক্তিকভাবে ভাগ করা উচিত, যাতে কোনো পক্ষই অতিরিক্ত চাপ অনুভব না করে।
৮. চরিত্র ও সুস্থতার মৌলিক সৌন্দর্য অর্জন করা
শারীরিক সৌন্দর্য পিছনে অযথা ক্লান্ত না হওয়া। গৃহসামগ্রীর অলিক সৌন্দর্যকে গুরুত্ব না দেয়া। এর পরিবর্তে ব্যক্তিত্ব গঠন ও চারিত্রিক সৌন্দর্য ধারণ এবং সুস্বাস্থ অর্জনের প্রতি পরিবাবর সদস্যদের সচেতনতা বাড়ানো উচিত।
৯. শিশুদের মানসিক সহায়তা
শিশুদের মানসিক অবস্থার প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া এবং তাদের সঠিক শিক্ষা ও আদর্শ প্রদান করা অত্যন্ত জরুরি।
১০. পারিবারিক সহায়তা নেটওয়ার্ক গঠন
পরিবারের বাইরে সহায়তার জন্য নেটওয়ার্ক গঠন করা উচিত, যেখানে অভিভাবকরা একে অপরকে সহযোগিতা এবং সমর্থন দিতে পারবেন।
বর্জনীয়:
১. অতিপরিমাণ প্রযুক্তি ব্যবহার
প্রযুক্তির মাধ্যমে পরিবারের সম্পর্কের মধ্যে অবিচ্ছিন্নতা তৈরি হতে পারে, তবে এর অতিরিক্ত ব্যবহার সম্পর্কের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। স্মার্টফোন এবং সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহারের সময় সীমিত করা উচিত।
২. পারিবারিক সম্পর্কের অবহেলা
কাজের বা অন্যান্য ব্যস্ততার কারণে পারিবারিক সম্পর্ক অবহেলা করা উচিত নয়। পরিবারের সদস্যদের সাথে সময় দেওয়ার মূল্য বুঝে আরো গুরুত্ব দেয়া উচিত।
৩. অতিরক্ত মানসিক চাপ
পারিবারিক জীবনে বা কর্মজীবনে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি না করা। প্রয়োজনে সাহায্য গ্রহণ বা সঠিক ভারসাম্য বজায় রাখা।
৪. অস্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা
অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, শারীরিক এবং মানসিক অবহেলা পারিবারিক সম্পর্কের উপর খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে। সুস্থ জীবনযাপন জরুরি।
৫. আত্মকেন্দ্রিক মনোভাব
পারিবারিক সম্পর্ক গঠনে একে অপরের অনুভূতির প্রতি মনোযোগ না দিলে, সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হতে পারে। সকলের প্রয়োজন ও অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা উচিত।
৬. বাহ্যিক সৌন্দর্যকে গুরুত্ব দেওয়া
পারিবারিক সদস্যদের বাহ্যিক সৌন্দর্যকে অতিরিক্ত গুরুত্ব না দিয়ে তাদের আভ্যন্তরীণ গুণাবলী এবং মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রাধান্য দিতে হবে।
৭. দাম্পত্য জীবনে বিশ্বাসের অভাব
বিশ্বাসহীনতা বা সন্দেহ পারিবারিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিপদ তৈরি করতে পারে। আন্তরিকতা এবং বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে সম্পর্ক গড়ে তোলা উচিত।
৮. শিশুদের শৃঙ্খলা ছাড়া বড় হওয়া
শিশুদের শৃঙ্খলা এবং আদর্শ শিক্ষা ছাড়াই তাদের বড় হতে দেওয়া উচিত নয়। পারিবারিক দায়িত্ববোধের মাধ্যমে তাদের সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে হবে।
৯. অর্থনৈতিক অস্বচ্ছতা
পারিবারিক অর্থনীতি সম্পর্কে পারস্পরিক আলোচনা এবং সঠিক পরিকল্পনা ছাড়া এগিয়ে যাওয়া কঠিন হতে পারে। সুষ্ঠু আর্থিক পরিকল্পনা অভাব থাকা উচিত নয়।
১০. বিরোধের সমাধান না করা
পারিবারিক অমিল বা বিরোধ থাকলে তা দ্রুত সমাধান করা জরুরি। বিরোধের সুষ্ঠু সমাধান না করা সম্পর্কের অবনতি ঘটাতে পারে।
তাই , সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে পরিবারের কাঠামো, রীতিনীতি এবং ভূমিকা পরিবর্তন ঘটতে পারে, কিন্তু পরিবারের প্রতি দায়বদ্ধতা, ভালোবাসা এবং সুরক্ষা কখনও পরিবর্তিত হওয়া উচিত নয়। পরিবারে সম্পর্ক, যত্ন এবং সহানুভূতির যে শক্তিশালী বুনন রয়েছে, সেটি পৃথিবীর কোনো পরিবর্তনই ছিন্ন করতে পারবে না, যদি আমরা এটি নিজেদের চেতনায় জীবিত রাখি।