আমীর হামযাহ
বিবাহ, ইসলামের একটি পবিত্র বিধান, যা শুধুমাত্র দুটি ব্যক্তির মধ্যে সম্পর্ক গড়ে তোলে না; বরং এটি একটি নতুন জীবনের সূচনা করে, যেখানে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও জীবনকে তাকওয়ার ভিত্তিতে গড়ে তোলার সুযোগ রয়েছে। একজন মুসলিমের জন্য বিবাহের প্রস্তুতি গ্রহণ শুধু আনুষ্ঠানিক কাজ নয়, বরং এটি একটি ধর্মীয় ও নৈতিক দায়িত্ব।
এই প্রবন্ধে আমরা একজন মুসলিম কীভাবে বিবাহের প্রস্তুতি নিতে পারে, তার বিস্তারিত দিকনির্দেশনা এবং গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ নিয়ে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।
১. আল্লাহর উপর ভরসা ও সঠিক নিয়ত নির্ধারণ
যেকোনো মহৎ কাজের শুরুতে নিয়তের বিশুদ্ধতা অপরিহার্য। বিবাহের উদ্দেশ্য যদি হয় আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা এবং পাপ থেকে নিজেকে বাঁচানো, তবে সেই বিবাহ হবে সত্যিকার অর্থেই বরকতময়।
পবিত্র হাদিসে নবীজী (সা.) বলেন, “তোমরা বিবাহ করো, কেননা বিবাহ তোমাদের দৃষ্টিকে সংযত করবে এবং লজ্জাস্থানকে হেফাজত করবে।” (সহীহ বুখারি, সহীহ মুসলিম)। সুতরাং, বিবাহের পূর্বে আল্লাহর প্রতি ভরসা রাখা এবং তাঁর অনুগ্রহ কামনা করা প্রতিটি মুসলিমের প্রধান কর্তব্য। পাশাপাশি নিয়ত শুদ্ধ রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ কাজের ফলাফল নির্ভর করে নিয়তের উপর।
২. সঙ্গী নির্বাচনে ধর্মপরায়ণতার অগ্রাধিকার
বিবাহের ক্ষেত্রে সঠিক সঙ্গী নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে ধর্মপরায়ণতা, নৈতিকতা এবং ভালো চরিত্রকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেওয়া উচিত। নবীজী (সা.) বলেছেন:
“নারীকে চারটি বিষয় বিবেচনা করে বিবাহ করা হয়: সম্পদ, বংশমর্যাদা, সৌন্দর্য এবং ধর্ম। তবে তোমরা ধর্মপরায়ণ নারীকে অগ্রাধিকার দাও, তাতে তোমরা সফল হবে।” (সহীহ বুখারি, সহীহ মুসলিম)।
ধর্মপরায়ণ জীবনসঙ্গী আপনাকে দুনিয়া ও আখিরাতের পথে চলতে সাহায্য করবে। সঠিক সঙ্গী নির্বাচন শুধু পারিবারিক শান্তি নয়, বরং সন্তানদের জন্যও একটি আদর্শ পরিবেশ তৈরি করতে সহায়ক। সঙ্গীর চরিত্র, আচার-আচরণ, দয়া ও সহমর্মিতার বিষয়গুলো বিবেচনা করা প্রয়োজন।
৩. আর্থিক ও সামাজিক প্রস্তুতি
বিবাহ শুধুমাত্র একটি ব্যক্তিগত সম্পর্ক নয়; এটি সামাজিক ও আর্থিক দায়িত্বের একটি বড় অধ্যায়। একজন মুসলিমকে বিবাহের পূর্বে নিশ্চিত করতে হবে যে তিনি আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী এবং পারিবারিক দায়িত্ব পালনে সক্ষম। কোরআনে বলা হয়েছে:
“তোমাদের মধ্যে যারা বিবাহযোগ্য, তাদের বিবাহ সম্পন্ন কর। যদি তারা দরিদ্র হয়, তবে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদের ধনী করে দেবেন।” (সুরা আন-নূর, আয়াত ৩২)।
বিবাহের খরচে অহেতুক অপচয় এড়িয়ে সরলতা বজায় রাখা উচিত। নবীজী (সা.) বলেছেন:
“সবচেয়ে বরকতময় বিবাহ হলো সেটি, যা সবচেয়ে কম খরচে সম্পন্ন হয়।” (ইবনে মাজাহ)।
এছাড়া বিবাহের জন্য সামাজিক সমর্থন এবং পারিবারিক অংশগ্রহণও গুরুত্বপূর্ণ। আর্থিক প্রস্তুতি মানে শুধু আয় করা নয়, বরং অর্থব্যবস্থাপনার দক্ষতা অর্জন করাও অপরিহার্য।
৪. ধর্মীয় শিক্ষা ও দাম্পত্য জীবনের নির্দেশনা
বিবাহের আগে কোরআন ও হাদিস থেকে দাম্পত্য জীবনের আদর্শ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করুন। নবীজী (সা.)-এর জীবন থেকে শিক্ষা নিন, যিনি ছিলেন পরিবার-পরিজনের প্রতি সবচেয়ে উত্তম।
নবীজী (সা.) বলেন:
“তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সেই ব্যক্তি, যে তার পরিবারের প্রতি উত্তম।” (তিরমিজি)।
সংসার জীবনের দায়িত্বগুলো জানতে এবং সেগুলোর যথাযথ বাস্তবায়নে ধর্মীয় জ্ঞান অপরিহার্য। এছাড়া দাম্পত্য জীবনের জন্য আল্লাহর প্রতি ভরসা এবং পরস্পরের প্রতি দয়া ও সম্মান প্রদর্শনের শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। ধর্মীয় শিক্ষার মাধ্যমে দাম্পত্য জীবনের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান পাওয়া সম্ভব।
৫. শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি
একটি সফল দাম্পত্য জীবনের জন্য শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিবাহের মাধ্যমে জীবনে যে পরিবর্তন আসবে, তা মেনে নেওয়ার মানসিকতা তৈরি করুন। নতুন সম্পর্ক ও দায়িত্বকে স্বাগত জানানোর জন্য নিজেকে মানসিকভাবে দৃঢ় করুন।
শারীরিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া যেমন জরুরি, তেমনি মানসিক প্রশান্তি বজায় রাখাও গুরুত্বপূর্ণ। একজন মুসলিমকে নিজের রাগ, হতাশা এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে শিখতে হবে।
৬. বিবাহের আনুষ্ঠানিকতা ও সরলতা বজায় রাখা
ইসলাম আমাদের শিক্ষা দেয় বিবাহে সরলতা বজায় রাখতে। বিয়েতে অপচয়, বিলাসিতা ও অপ্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা পরিত্যাগ করুন।
নবীজী (সা.) বলেছেন:
“সবচেয়ে বরকতময় বিবাহ সেই, যা সহজে সম্পন্ন হয়।” (আবু দাউদ)।
মেহেরের পরিমাণ সহ বিবাহের প্রতিটি বিষয় স্বচ্ছভাবে নির্ধারণ করা উচিত। এছাড়া আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে হবে, যেখানে ইসলামী সংস্কৃতি এবং সরলতার প্রতিফলন থাকবে।
৭. স্বামী-স্ত্রীর অধিকার ও দায়িত্ব
বিবাহ কেবল একটি সামাজিক সম্পর্ক নয়, এটি একটি দায়িত্বপূর্ণ বন্ধন। এ বন্ধনে স্বামী ও স্ত্রীর উভয়েরই কিছু অধিকার এবং দায়িত্ব রয়েছে, যা সঠিকভাবে পালন করতে হবে।
স্বামীর প্রধান দায়িত্ব হলো স্ত্রীর প্রয়োজন মেটানো, তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং তাকে ভালোবাসা ও সম্মানের সঙ্গে দেখভাল করা। নবীজী (সা.) বলেন:
“তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সেই ব্যক্তি, যে তার স্ত্রীর সঙ্গে উত্তম আচরণ করে।” (তিরমিজি)।
অন্যদিকে, স্ত্রীর দায়িত্ব হলো স্বামীর সম্মান করা, তার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করা এবং সংসারের দায়িত্ব পালন করা। তবে এই সম্পর্কের মূল ভিত্তি হলো পারস্পরিক বোঝাপড়া এবং সহমর্মিতা। উভয়ের উচিত নিজের সীমাবদ্ধতাগুলো বোঝা এবং অপরজনের প্রতি সহনশীল হওয়া।
স্ত্রীকে ভালোবাসা প্রকাশে নবীজী (সা.) ছিলেন অনন্য উদাহরণ। তিনি বলতেন, “তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সেই ব্যক্তি, যে তার পরিবারের প্রতি উত্তম আচরণ করে।” (তিরমিজি, হাদিস: ৩৮৯৫)
৮. সমস্যার সমাধানে ধৈর্য ও নম্রতা
সংসার জীবনে ছোটখাটো সমস্যা থাকবেই। এগুলোর সমাধানে ধৈর্য ধরুন এবং নম্রতার সঙ্গে আলাপ করুন। সমস্যা গোপন রাখুন এবং তৃতীয় পক্ষের কাছে না নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করুন।
পরস্পরের মতামত শুনুন এবং সমঝোতার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করুন। তর্ক-বিতর্ক বা দোষারোপের পরিবর্তে আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করুন।
৯. বিবাহের আগে ও পরে দোয়া
বিবাহের প্রস্তুতিতে এবং বিবাহের পরে দোয়া করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি দাম্পত্য জীবনে বরকত আনার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। নিচে বিবাহের পূর্বে ও পরে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দোয়া দেওয়া হলো:
১. বিবাহের আগে:
বিবাহের জন্য সঠিক সঙ্গী এবং বরকতময় জীবন চেয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করুন। কোরআনে আল্লাহ বলেন:
“তারা বলে, হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদের স্ত্রীগণ ও সন্তানদেরকে আমাদের চোখের শীতলতা দান করুন এবং আমাদেরকে মুত্তাকীদের ইমাম বানান।” (সুরা আল-ফুরকান: ৭৪)
২. নবদম্পতির জন্য দোয়া:
নবীজী (সা.) নবদম্পতির জন্য এই দোয়া শিখিয়েছেন:
“বারাকাল্লাহু লাকা, ওয়া বারাকা আলাইকা, ওয়া জামা’য়া বাইনাকুমা ফি খাইর।”
(অর্থ: আল্লাহ তোমার জন্য বরকত দান করুন, তোমার উপর বরকত নাযিল করুন এবং তোমাদের উভয়কে কল্যাণে একত্রিত করুন।) (তিরমিজি, হাদিস: ১০৯১)
৩. সংসার জীবনের জন্য দোয়া:
সংসারের শান্তি এবং সমৃদ্ধির জন্য দোয়া করতে পারেন:
“রাব্বানা আতিনা ফিদ্দুনিয়া হাসানাতাও ওয়াফিল আখিরাতি হাসানাতাও ওয়াকিনা আযাবান নার।”
(অর্থ: হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদেরকে দুনিয়াতে কল্যাণ দাও, আখিরাতেও কল্যাণ দাও এবং আমাদের জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা কর।) (সুরা আল-বাকারা: ২০১)
৪. দাম্পত্য জীবনের জন্য বিশেষ দোয়া:
যেন উভয়ের মধ্যে ভালোবাসা ও শান্তি বজায় থাকে, এজন্য দোয়া করতে পারেন:
“রাব্বি হাবলি মিন লাদুংকা জরিয়্যাতান তাইয়িবাতা। ইন্নাকা সামিউদ দু’আ।”
(অর্থ: হে আমার প্রতিপালক! আপনার পক্ষ থেকে আমাকে পবিত্র সন্তানের বরকত দিন। নিশ্চয়ই আপনি প্রার্থনা শ্রবণকারী।) (সুরা আল-ইমরান: ৩৮)
১০. বিবাহ: তাকওয়ার ভিত্তিতে একটি চুক্তি
বিবাহ কেবল একটি সামাজিক চুক্তি নয়; এটি তাকওয়ার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা একটি বন্ধন। এই চুক্তি শুধু দুনিয়াবি স্বার্থে নয়, বরং আখিরাতে শান্তি ও মুক্তি লাভের উদ্দেশ্যে করা হয়। আল্লাহ বলেন:
“এবং তাদের মধ্য থেকে তোমাদের জন্য স্ত্রী সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তি পাও। আর তিনি তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন।” (সুরা আর-রুম: ২১)
স্বামী ও স্ত্রীর সম্পর্ক এমন হওয়া উচিত, যেখানে পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা, দয়া এবং দায়িত্বশীলতা বিদ্যমান। নবীজী (সা.) আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন, যখন কোনো ব্যক্তি বিবাহ সম্পন্ন করে, তখন সে তার অর্ধেক দ্বীন পূর্ণ করে। অবশিষ্ট অর্ধেকের ব্যাপারে সে যেন আল্লাহকে ভয় করে।” ((মুসতাদরাক আল হাকিম, হাদিস: ২৭৩৪,)
তাই এই চুক্তিকে পূর্ণতায় পৌঁছানোর জন্য উভয়েরই তাকওয়ার ভিত্তিতে জীবন পরিচালনা করা প্রয়োজন।
তাকওয়ার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা দাম্পত্য জীবন শুধু সংসারকে সুখী করবে না, বরং একটি আদর্শ সমাজ গঠনের ক্ষেত্রেও সহায়ক হবে।
একজন মুসলিমের বিবাহের প্রস্তুতি মানে কেবল আচার-অনুষ্ঠান নয়; এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনধারা গঠনের প্রক্রিয়া। ধর্মীয় নির্দেশনা, পারিবারিক পরামর্শ, আর্থিক পরিকল্পনা এবং দায়িত্বশীল মানসিকতা এই প্রস্তুতিকে সাফল্যমণ্ডিত করে।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিক পথে পরিচালিত করুন এবং আমাদের দাম্পত্যজীবনকে বরকতময় করুন। আমিন।