আমীর হামযাহ
বৈবাহিক সম্পর্ক কি কেবল ভালোবাসার উপর নির্ভরশীল? যদি কখনো ভালোবাসা কমে যায়, তবে কি সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা সম্ভব? এ প্রশ্নগুলোর উত্তরে আমরা ইসলামের কর্যকর দিকনির্দেশনা খুঁজে পাই।
সমাজের দৃষ্টিতে ভালবাসা
ভালোবাসা নিয়ে মানুষের অন্তরে আছে নানান রকম অনুভূতি। কেউ বলেন, “ভালোবাসা অন্ধ,” কেউ বলেন, “ভালোবাসা এক জীবনের স্বপ্ন।” তবে ভালোবাসার প্রকৃত স্বরূপ বুঝতে গেলে আমাদের দেখতে হবে যে এটি কেবল অনুভূতি নয়, এটি এক বিশাল দায়িত্ব এবং বন্ধনের প্রতীক। বৈবাহিক সম্পর্ক তাই ভালোবাসার পাশাপাশি দয়া, সম্মান এবং বিশ্বাসের মতো মূল্যবান উপাদানের উপর নির্ভরশীল।
ইসলামে ভালোবাসার বিভিন্ন ধাপ
ইসলাম ভালোবাসার প্রতি গভীরভাবে মনোযোগ দেয় এবং এটি জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধারণ করে। প্রস্তুতিপর্ব, বিবাহকালীন, এবং বিবাহোত্তর প্রতিটি ধাপের জন্য ইসলাম নির্দিষ্ট সীমানা এবং শুদ্ধতার নিয়ম প্রণয়ন করেছে।
১. বিবাহপূর্ব সম্পর্কের সীমাবদ্ধতা
ইসলামে বিবাহপূর্ব সম্পর্ক কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন: “তোমরা কোমলভাবে কথা বলো না, যাতে যার অন্তরে রোগ আছে সে প্রলুব্ধ না হয়।” (সূরা আহযাব, আয়াত: ৩২)
এই নির্দেশনা আমাদের শেখায় যে, বিবাহপূর্ব সম্পর্কের প্রতি সাবধান থাকতে হবে। এর কারণ হচ্ছে, এই ধরনের সম্পর্ক আমাদের নৈতিকতা এবং পারিবারিক কাঠামো দুর্বল করে দিবে পাশাপাশি দুনিয়া আখেরাতও বরবাদ করে দিবে।
২. বিবাহের প্রস্তুতিতে ইসলাম বলে
ইসলাম বিবাহ প্রস্তাবের সময় পারস্পরিক সম্মতি এবং ভালোবাসার ভিত্তি স্থাপন করার সুযোগ দেয়। মুগীরাহ বিন শু’বাহ (রাঃ) বলেছেন, “এক মহিলার সাথে মুগীরাহ বিন শু’বাহর বিয়ের কথা পাকা হল। তিনি তাকে বললেন, ‘তাকে দেখে নাও। কারণ তাতে বেশি আশা করা যায় যে, তোমাদের ভালবাসা চিরস্থায়ী হবে।’” (৫৬৭: আহমাদ ৪/২৪৪, ২৪৬; তিরমিযী ১০৮৭ নং; নাসাঈ ৬/৬৯; ইবনে মাজাহ ৮৬৬ নং)।
এই সময়ের ভালোবাসা সরল এবং পরিষ্কার হওয়া উচিত, যা ভবিষ্যতের সম্পর্ককে মজবুত ভিত্তি প্রদান করবে।
৩. বিবাহ-পরবর্তী সম্পর্কের মাধুর্য
বিবাহের পর স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভালোবাসা, দয়া, এবং বোঝাপড়ার প্রয়োজন অপরিসীম। আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেন: “তিনি তোমাদের মধ্যে মমতা ও দয়া স্থাপন করেছেন।” (সূরা রূম, আয়াত: ২১)
এই আয়াত আমাদের শেখায় যে, একটি সম্পর্কের মজবুত ভিত্তি হলো মমতা এবং দয়া। যদি কখনো ভালোবাসা কমে যায়, তবে দয়া সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখার মূল ভিত্তি হতে পারে।
সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখা
ইসলামে বৈবাহিক সম্পর্ককে শুধু ভালোবাসার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়নি। কুরআনে বলা হয়েছে: “তাঁর নিদর্শনসমূহের মধ্যে রয়েছে মমতা এবং দয়া।”
ইবনে কাসির (রহ.) ব্যাখ্যা করেছেন, “পুরুষ তার স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখে ভালোবাসার জন্য অথবা দয়ার জন্য।” অর্থাৎ, ভালোবাসা ক্ষীণ হলেও দয়া এবং দায়িত্বের মাধ্যমে সম্পর্ককে জীবন্ত রাখা যায়।
আধুনিক সমাজের ভুল ব্যাখ্যা
পশ্চিমা সংস্কৃতি প্রায়ই সম্পর্ককে শুধু রোমান্টিক ভালোবাসার উপর নির্ভরশীল হিসেবে তুলে ধরে। কিন্তু ইসলাম আমাদের শেখায় যে, সম্পর্ক কেবল শারীরিক আকর্ষণ বা রোমান্স নয়; এটি দায়িত্ব, দয়া এবং নৈতিকতা দিয়ে গঠিত।
ইসলামে সম্পর্কের মহৎ উদ্দেশ্য
বৈবাহিক সম্পর্কের উদ্দেশ্য কেবল আকর্ষণ বা রোমান্স নয়। এটি একটি বন্ধন, যা পারস্পরিক শ্রদ্ধা, বোঝাপড়া এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুদৃঢ় ভিত্তি স্থাপন করে।
হযরত ওমর (রা.) বলেছিলেন এক ব্যক্তিকে, যিনি তার স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে চেয়েছিলেন: “তুমি কি কেবল ভালোবাসার ভিত্তিতে একটি বাড়ি গড়ে তুলবে? কোথায় দয়া এবং সম্মান?”
ইসলামে বৈবাহিক সম্পর্ক কেবল ভালোবাসার উপর নির্ভরশীল নয়। এটি দয়া, দায়িত্ব, এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধার উপর ভিত্তি করে তৈরি। যদি কোনো সময় ভালোবাসা হ্রাস পায়, তবে দয়া এবং সম্মান সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে।
ভালোবাসা জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ, তবে এটি জীবনের একমাত্র ভিত্তি নয়। সম্পর্কের মূল শক্তি হলো বিশ্বাস, দায়িত্ববোধ, এবং আল্লাহর প্রতি আনুগত্য। এই ভারসাম্যপূর্ণ এবং মায়াবি দৃষ্টিভঙ্গিই একটি সুখী, শান্তিপূর্ণ, এবং দীর্ঘস্থায়ী বৈবাহিক সম্পর্কের চাবিকাঠি।