আমীর হামযাহ
মানব সমাজের ভিত্তি নারীর ও পুরুষের এক অপরিহার্য সমন্বয়। নারী শুধু পুরুষের সঙ্গী নয়, সমাজের অবিচ্ছেদ্য প্রাণকেন্দ্র; মা, বোন, স্ত্রী বা কন্যা হিসেবে তার অস্তিত্ব সমাজের ভারসাম্য রক্ষায় অপরিসীম অবদান রাখে। মহান আল্লাহর সৃষ্টির নিখুঁত পরিকল্পনায় নারীর ভূমিকা অতুলনীয়। নারীর অবদানে সমাজের সৃষ্টিশীলতা ও সমতা প্রতিষ্ঠিত হয়। এই মহান মূল্যবোধের প্রতিফলনই ইসলামে নারীর অধিকার ও মর্যাদায় সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়। আল্লাহ তায়ালা নারীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে তার উত্তরাধিকার নিশ্চিত করেছেন, সন্তানকে আদর্শভাবে লালন-পালনের দায়িত্ব দিয়েছেন, স্বামীকে স্ত্রীর ভরণ-পোষণের তাগিদ দিয়েছেন এবং পিতাকে সন্তানদের সুষ্ঠু প্রতিপালনে উৎসাহিত করেছেন। কিন্তু মানব ইতিহাসে জাহেলি যুগে নারী ছিল অধিকারহীন, অবহেলিত ও লাঞ্ছনার শিকার। তখন নারী সম্পদে বঞ্চিত, তার অধিকার পেতো ভিক্ষুকের মতো।
বর্তমান যুগে, দুঃখজনক হলেও সত্য, ইসলাম ও নারীর অধিকার নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোর চক্রান্ত চলছে। বিশেষত আমাদের দেশ বাংলাদেশে, যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম, পশ্চিমা প্রভাবিত কিছু স্বার্থপর গোষ্ঠী ‘নারী-পুরুষ বৈষম্য দূরীকরণ’ শীর্ষক আড়ালে ইসলামের বিধান ও রক্ষণশীল নারীদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। তারা কুরআনের “এক ছেলে পাবে দুই মেয়ের অংশ” বিধান বিলুপ্তির দাবিসহ নারী-পুরুষের সম্পদে সমতা চান। যদিও তারা সে দাবি পাশ করাতে পারেনি, তথাপি সরলমনা ও ইসলামী জ্ঞানহীন নারীদের মাঝে ইসলামী বিধানকে অধিকার হরণকারী একটি অবৈধ ব্যবস্থা হিসেবে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা চালাচ্ছে, যা ধর্মপ্রাণ মুসলিম সমাজের মধ্যেও বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে।
এই প্রবন্ধে আমরা আলোচনা করব—ইসলামের নারী উত্তরাধিকার বিধানের যৌক্তিকতা ও মানবিকতা এবং নারীবাদের মিথ্যা দাবির অসারতা, ইনশাআল্লাহ।
ইসলামী উত্তরাধিকার বিধানের বৈশিষ্ট্য ও মূলনীতি
নারীর উত্তরাধিকার বিষয়ক আলোচনার আগে ইসলামী উত্তরাধিকার ব্যবস্থার কিছু মূল বৈশিষ্ট্য জানা অত্যন্ত জরুরি, কারণ তা বহু বিভ্রান্তি দূর করতে সাহায্য করে।
ইসলাম সমান বন্টনের প্রতি নয়, বরং সুষম বন্টনের নীতি অনুসরণ করে। মানুষের অবস্থান, প্রয়োজন এবং দায়িত্ব বিবেচনা করেই অংশ নির্ধারণ করা হয়। যেমন, একটি পরিবারে সদস্য বেশি থাকলে তাদের অংশ বেশি হবে; যেখানে সদস্য কম, অংশ কম হবে—সুতরাং সমান নয়, ন্যায়সঙ্গত অংশ বণ্টন এখানে মন্ত্র। এটা হলো ইনসাফের প্রকৃত রূপ। এই নীতিকেই অনুসরণ করেছে ইসলামের উত্তরাধিকার ব্যবস্থা।
আরো বড় ব্যাপার হলো, ইসলাম পুরুষ কিংবা নারীর প্রতি পক্ষপাত করে না। এখানে অংশ নির্ধারণ হয় মৃত ব্যক্তির নিকটাত্মীয়তা, তাদের আর্থিক ও সামাজিক অবস্থান, এবং উত্তরাধিকারীদের দায়িত্ব বিবেচনা করে। যেমন, ছেলে মেয়ের তুলনায় দ্বিগুণ অংশ পাওয়ার কারণ হল ছেলের ওপর পরিবারের আর্থিক ও সামাজিক দায়িত্ব বেশি থাকা।
ইসলাম দুর্বল ও বঞ্চিতদের প্রতি করুণা প্রদর্শন করে। জাহেলি যুগে নারী ও শিশুকে ওয়ারিস হিসেবেই গণ্য করা হতো না; অনেক সময় তারা সম্পদ থেকে বঞ্চিত হতো। ইসলাম সেই অন্যায় দূর করে তাদেরকে যথাযথ অংশ দিয়েছে।
আত্মীয়তার বন্ধন দৃঢ় করাও ইসলামের অন্যতম লক্ষ্য। পবিত্র কোরআনে এসেছে, “রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়রা একে অপরের কাছে অধিক হক্বদার।” (সূরা আল-আনফাল, আয়াত ৭৫)।
নারীর উত্তরাধিকার: যুগান্তকারী ও ন্যায়সঙ্গত বিধান
ইসলামী উত্তরাধিকার আইন নারীদের ঐতিহাসিক বঞ্চনা থেকে মুক্তি দিয়েছে এবং তাদের সম্পদে অংশ পেতে সম্মানের আসনে বসিয়েছে। প্রাচীন রোমান ও ইহুদি আইন নারীদের সম্পদে অংশ দিতে অস্বীকৃতি জানাত, কিন্তু ইসলাম তা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।
কুরআনে স্পষ্ট নির্দেশনা আছে, “হে ঈমানদারগণ, তোমাদের জন্য বৈধ নয় যে তোমরা জোরপূর্বক নারীদের উত্তরাধিকারী হও।” (সূরা আন-নিসা: ১৯)। অর্থাৎ, নারীর অধিকারকে শক্তভাবে সুরক্ষিত করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞ মুফাসসিরগণ বলেছেন, ইসলামের আগের সমাজে নারীরা সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত ছিল, কিন্তু আল্লাহর হুকুমে তারা এখন নির্দিষ্ট অংশ পায়, যা পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে পুরুষদের থেকে কম বা বেশি হতে পারে।
উত্তরাধিকারীদের মধ্যে ১২ জন নির্দিষ্ট হয়েছে, যেখানে ৮ জন নারী এবং ৪ জন পুরুষ। নারীরাও বিভিন্ন ক্ষেত্রে পুরুষদের সমান বা অধিকাংশ অংশ পেতে পারে।
ছেলের দ্বিগুণ অংশ পাওয়ার কারণ ও বাস্তবতা
“ছেলে পাবে মেয়ের দ্বিগুণ অংশ” (সূরা আন-নিসা: ১১) এই বিধান নিয়ে অনেক ভুল ধারণা প্রচলিত। এটি সব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়; কেবল ছেলে-মেয়ে এবং ভাই-বোনদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
এর কারণ হলো:
- পরিবারের আর্থিক ও সামাজিক দায়িত্ব পুরুষের ওপর বেশি (স্ত্রীর ভরণপোষণ, সন্তানের লালন, পিতামাতার সেবা ইত্যাদি)।
- বিয়ের সময় দেনমোহর সহ স্ত্রীর যাবতীয় খরচ পুরুষ বহন করে।
- তাই ইনসাফের নামে ছেলেকে মেয়ের তুলনায় দ্বিগুণ অংশ দেওয়া হয়েছে, যা সুষম বণ্টনের এক বাস্তব উদাহরণ।
নারীর অংশের তুলনায় বাস্তব চিত্র
মিসরের জাতীয় ফতোয়া বোর্ডের তথ্যে দেখা যায়, নারীর পুরুষের অর্ধেক পাওয়ার ক্ষেত্র খুবই সীমিত; বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা সমান বা অধিকাংশ অংশ পায়।
নারীর পুরুষের অর্ধেক পাওয়ার প্রধান চারটি অবস্থা:
- মেয়ে ও নাতনী (ছেলের মেয়ে) ছেলে ও নাতীর উপস্থিতিতে।
- মা পায় পিতার অর্ধেক, যদি ছেলে ও স্বামী না থাকে।
- সহোদর বোন ও বৈমাত্রেয় বোন যখন ভাইয়ের সাথে ওয়ারিস হয়।
নারী সমান অংশ পায় ১০টিরও বেশি ক্ষেত্রে, যেমন:
- বৈপিত্রেয় ভাই-বোন সবসময় সমান অংশ পায়।
- সহোদর বোন ও স্বামী একসঙ্গে ওয়ারিস হলে সমান অংশ পায়।
- মা ও নানী প্রভৃতি পুরুষের সমান অংশ পায়।
কিছু ক্ষেত্রে নারীরা ভাইদের চেয়ে বেশি অংশ পায়, যেমন:
- স্বামী থাকলে একমাত্র কন্যা অর্ধেক পায়, স্বামী পায় এক চতুর্থাংশ।
- দুই কন্যা থাকলে তারা দুই-তৃতীয়াংশ পায়।
- কিছু ক্ষেত্রে বোনেরা ভাইদের চেয়ে অধিক অংশ পায়।
নারীর উত্তরাধিকার বঞ্চনা একেবারেই ভিত্তিহীন
অনেক সময় দেখা যায় নারীরাই অংশ পেয়েও পুরুষ বঞ্চিত হয়, যেমন:
- নাতনী পায় অংশ, কিন্তু নাতী পায় না।
- বৈমাত্রেয় বোন পায়, কিন্তু বৈমাত্রেয় ভাই পায় না।
- নানা বঞ্চিত হলেও নানী সম্পূর্ণ অংশ পায়।
এসব প্রমাণ করে “নারী পুরুষের অর্ধেক পায়” ধারণাটি অনেকাংশে ভুল ও অজ্ঞতার নিদর্শন। একজন মনীষী বলেছিলেন, “ইসলাম যদি ইনসাফ না হত, তাহলে আমি বলতাম নারীর বিপরীতে পুরুষকে ঠকানো হয়েছে।”
কেন ছেলে মেয়ের দ্বিগুণ অংশ পায়?
ছেলেকে দ্বিগুণ অংশ দেওয়ার যুক্তি হলো তার ওপর পরিবারের আর্থিক ও সামাজিক দায়িত্ব বেশি পড়ে। যেমন:
- পরিবারের সকল খরচ বহন।
- পিতা-মাতার সেবা ও সন্তান লালন।
- স্ত্রীর যাবতীয় অধিকার পূরণ।
অপরদিকে মেয়ে এই দায়িত্ব থেকে মুক্ত থাকে। সুতরাং, এটি ন্যায়সঙ্গত ও মানবিক সুষম বণ্টনের প্রতিফলন।
ইসলামের উত্তরাধিকার বিধান: মানবিক ও ন্যায়পরায়ণ
ইসলামের উত্তরাধিকার বিধান অত্যন্ত ন্যায়পরায়ণ ও মানবিক। প্রত্যেক ওয়ারিস তার যথাযথ অংশ পায়। অমুসলিম চিন্তাবিদ Gostaf lobon ইসলামের উত্তরাধিকার আইনকে ফরাসি ও ব্রিটিশ আইন থেকে অনেক বেশি ন্যায়সঙ্গত ও যৌক্তিক বলে অভিহিত করেছেন।
আল্লাহর বিধান সর্বকালীন ও সর্বজনীন। তাঁর আইন অনুসরণ করলে সমাজে শান্তি, ন্যায় ও সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠিত হয়।
ইসলাম ও উত্তরাধিকার: পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান
ইসলাম মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গ দিকনির্দেশনা প্রদান করে। উত্তরাধিকার বণ্টনেও এর বিধান সর্বোচ্চ এবং অটল। কোরআন ও হাদিসে উত্তরাধিকার সম্পর্কে স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে এবং তা পরিবর্তন বা অবহেলা কঠোর নিষেধাজ্ঞার মধ্যে।
মা-বাবা, সন্তান-সন্ততি, স্বামী-স্ত্রীর অংশ নির্দিষ্ট করে আল্লাহ সুবিচার ও ভালোবাসার সেতুবন্ধন গড়ে তুলেছেন।
ইসলামী উত্তরাধিকার আইন ও সমাজে এর গুরুত্ব
ইসলাম আত্মীয়তার অধিকারের প্রতি গভীর গুরুত্ব দেয়। বাবা-মা, সন্তান, স্বামী-স্ত্রী প্রথম পর্যায়ে অংশ পায়।
ছেলে মেয়েকে অংশ দেয়া হয়েছে, তবে ছেলে দ্বিগুণ পায় কারণ সে পরিবারের আর্থিক ও সামাজিক ভার বহন করে।
ওসিয়তের অংশ ও এতিম, দরিদ্র, অসহায়দের সুরক্ষা ইসলামী উত্তরাধিকার ব্যবস্থার বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
আল্লাহর নির্দেশ ও শেষ কথা
আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, “এগুলো আমার নির্ধারিত সীমারেখা। যারা এ সীমারেখা মেনে চলে তাদের জন্য জান্নাত রয়েছে। যারা অতিক্রম করে তাদের জন্য কঠোর শাস্তি।” (সূরা আন-নিসা: ১২)
অতএব, ইসলামের উত্তরাধিকার বিধান মানবিক, ন্যায়সঙ্গত এবং সমাজে শান্তি ও সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠার অনন্য দিক নির্দেশনা। নারীর সম্পদের অংশ নির্ধারণে ইসলাম যুগান্তকারী ভূমিকা রেখেছে, যা সকলের সম্মিলিত কল্যাণ নিশ্চিত করে।