আমীর হামযাহ
প্রতিটি মানুষের জীবনে কিছু অমূল্য রত্ন থাকে, যেগুলি কখনোই ধূলির মতো মলিন হতে পারে না। আমাদের মা-বাবার ভালোবাসা, ত্যাগ এবং সেবা তেমনই এক অমূল্য রত্ন, যা জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে আমাদের অনুপ্রাণিত করে। যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের হলরুমে প্রবেশ করি, সেখানে নানা ধরনের ছবি চোখে পড়ে, কিন্তু কিছু ছবি আমাদের মনকে গভীরভাবে স্পর্শ করে—তার মধ্যে অন্যতম হলো মা-বাবার ছবি। এই ছবি শুধু ফটোফ্রেমের মধ্যে বন্দী নয়, বরং আমাদের হৃদয়ে একটি চিরস্থায়ী স্থান অধিকার করে নেয়। আমাদের আজকের অবস্থান, সাফল্য এবং সুখের সবকিছুই একমাত্র তাদের কষ্ট ও ত্যাগের কারণে। তাঁদের ভালোবাসার হাত ধরেই আমরা পৌঁছেছি আজকের জায়গায়। তাদের সেবা এবং শ্রদ্ধা কেবল ধর্মীয় কর্তব্য নয়, এটি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেও এক অমূল্য দায়িত্ব। পিতা-মাতার প্রতি শ্রদ্ধা এবং সেবা মানবতার উন্নতির মূল চাবিকাঠি। সুতরাং, আমাদের এই পৃথিবীতে প্রত্যেকটি কাজের ভিত্তি যদি কিছু থাকে, তা হলো মা-বাবার প্রতি সেবা এবং শ্রদ্ধা।
পিতা-মাতার সেবা: ধর্মীয় ও মানবিক দায়িত্ব
আল্লাহ তাআলা কুরআনে পিতা-মাতার প্রতি শ্রদ্ধা ও সেবার উপর অসংখ্য বার গুরুত্ব আরোপ করেছেন। সবচেয়ে বড় পাপ হল শিরক, এবং তার পরেই আসে পিতা-মাতার প্রতি অবহেলা। আল্লাহ তাআলা সুরা নিসার ৪:২৬ আয়াতে ঘোষণা করেছেন, “ওয়াবুদু আল্লাহ ওয়ালা তুশরীকু বিহি শাইয়ান ওয়াবিল ওয়ালিদাইন ইহসানান,” অর্থাৎ “আল্লাহর ইবাদত করো এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক করো না, এবং পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করো।” এই আয়াতের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, পিতা-মাতার সেবা শুধুমাত্র ধর্মীয় আদেশ নয়, বরং এটি ঈমানের একটি অপরিহার্য অংশ। পিতা-মাতার ত্যাগ ও ভালবাসার কারণে আমাদের জীবন সুন্দর হয়ে ওঠে, এবং তাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সেবা আমাদের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব।
পিতা-মাতার প্রতি কুরআনের স্পষ্ট নির্দেশনা
কুরআনের সূরা বনী ইসরাইল (১৭:২৩-২৪) আয়াতে আল্লাহ তাআলা পিতা-মাতার প্রতি শ্রদ্ধা ও সদ্ব্যবহার সম্পর্কে আরো বিস্তারিত নির্দেশ দিয়েছেন। এখানে বলা হয়েছে, “যদি তোমার কাছে তোমার পিতা-মাতা বৃদ্ধ বয়সে উপনীত হয়, তবে তাদের সাথে ‘উফ’ পর্যন্ত বলো না, তাদের ধমক দিয়ো না, বরং তাদের সাথে সম্মানজনক কথা বলো। তাদের প্রতি বিনীত হয়ে নিজের জীবনের মায়া ভুলে যাও, এবং প্রার্থনা করো, হে আমার প্রভু, তাদের প্রতি তুমি সেই রকম দয়া করো যেভাবে তারা আমার ছোটবেলায় আমাকে লালন-পালন করেছে।” এখানে আল্লাহ তাআলা পিতা-মাতার প্রতি শ্রদ্ধা, সহানুভূতি এবং সহিষ্ণুতা প্রদর্শনের জন্য আমাদের তাগিদ দিয়েছেন। এমনকি যখন তারা বৃদ্ধ বয়সে পৌঁছান, তখন তাদের প্রতি আরও বেশি স্নেহ এবং সহানুভূতি প্রদর্শনের নির্দেশ দিয়েছেন। আমাদের জীবনযাত্রা যতই ব্যস্ত হোক, পিতা-মাতার প্রতি শ্রদ্ধা, তাদের সেবা কখনোই অবহেলিত হওয়া উচিত নয়।
পিতা-মাতার সেবা: মানবিক মূল্যবোধের প্রমাণ
আজকের সমাজে একদিকে যেমন ব্যক্তি স্বাধীনতার গুরুত্ব রয়েছে, অন্যদিকে সামাজিক বন্ধনও ততটাই গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান সমাজে পিতা-মাতার সেবা মাঝে মাঝে লোক দেখানো বিষয় হিসেবে পরিগণিত হতে পারে। অনেক মানুষ জীবনের তাগিদে এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে, যে তারা পিতা-মাতার সেবা বা সম্মান প্রদর্শন করার সুযোগই পায় না। আধুনিক জীবনের দ্রুতগতি, অর্থনৈতিক চাপ এবং সামাজিক চাহিদার মধ্যে, পিতা-মাতার প্রতি শ্রদ্ধা এবং তাদের প্রতি সেবা প্রদর্শন অনেকের কাছেই একটি দূরবর্তী ভাবনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ, একটি শক্তিশালী সমাজ তখনই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে যখন এর সদস্যরা তাদের পারিবারিক দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করবে। পিতা-মাতার প্রতি শ্রদ্ধা এবং তাদের সেবা করার বিষয়টি যদি আমরা আমাদের জীবনে গুরুত্ব না দিই, তবে সেই সমাজ কখনোই আদর্শ সমাজ হতে পারে না।
পিতা-মাতার সেবা এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য
আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির মূল ভিত্তি হচ্ছে পরিবার, এবং পরিবারে পিতা-মাতার সেবা ও শ্রদ্ধা। আমাদের পূর্বপুরুষরা সন্তানের কাছে তাদের জীবনের সেরা সময় কাটানোর পরামর্শ দিয়েছেন, কিন্তু আজকাল আমরা যে চিত্র দেখতে পাচ্ছি, তা একদম বিপরীত। অনেক সন্তান তাদের পিতা-মাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেয়, যেখানে তাদের প্রয়োজনীয় সেবা এবং যত্নের অভাব থাকে। এর মূল কারণ হলো আমাদের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের অবমূল্যায়ন। যখন আমরা পিতামাতার প্রতি আমাদের দায়িত্ব পালন করি না, তখন আমাদের মানবিক মূল্যবোধও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমাদের পূর্বপুরুষরা যেভাবে তাদের পিতা-মাতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন, আমাদেরও উচিত সেই পথ অনুসরণ করা।
পিতা-মাতার সেবা এবং নবীজির আদর্শ
প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবন আমাদের জন্য এক অমূল্য শিক্ষা। তিনি নিজে পিতা-মাতার প্রতি কীভাবে শ্রদ্ধাশীল ছিলেন, তা আমরা জানি। নবীজির আদর্শ অনুসরণ করেই আমাদের উচিত মা-বাবার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনোই তাদের অবহেলা করেননি, বরং সবসময় তাদের সঙ্গে সৌজন্যপূর্ণ আচরণ করেছেন। নবীজির এই চরিত্র আমাদের জীবনের এক অনবদ্য দৃষ্টান্ত। তিনি তাঁর সঙ্গী হযরত হাসান ও হুসাইনকে কোলে তুলে নিতেন, তাদের সাথে খেলা করতেন, কিন্তু কখনোই তাদের সঙ্গে রূঢ় বা অশালীন আচরণ করেননি। এমন এক মহান আদর্শ আমাদের পথ প্রদর্শন করছে, যা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে প্রতিফলিত হওয়া উচিত।
পিতা-মাতার সেবা এবং মানসিক সহানুভূতি
পিতা-মাতার সেবা শুধু শারীরিক বা দৈহিক নয়, এটি মানসিক ও আবেগীয় সঙ্গতিও প্রয়োজন। বৃদ্ধ বয়সে পিতা-মাতা তাদের মনোযোগ এবং সহানুভূতির অধিক প্রয়োজন অনুভব করেন। তাদের জীবনের এই বিশেষ সময়ে আমাদের সহানুভূতির প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। তারা মানসিকভাবে দুর্বল হতে পারেন, এবং এই সময় তাদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের সহানুভূতি প্রকাশ করা আমাদের কর্তব্য। যেভাবে তারা আমাদের শৈশবে স্নেহ ও সহানুভূতি দিয়ে আমাদের লালন-পালন করেছেন, তেমনি আমাদেরও তাদের এই বয়সে সেই একই স্নেহ, ভালোবাসা ও সহানুভূতি প্রদর্শন করা উচিত। যদি আমরা এই দায়িত্ব পালন করি, তবে আমাদের পিতা-মাতা কখনোই একাকীত্ব অনুভব করবেন না, এবং তাদের মানসিক অবস্থা আরও উন্নত হবে।
সমাপ্তি: পিতা-মাতার সেবা, মানবিক কর্তব্য
পিতা-মাতার সেবা একেবারেই একটি ধর্মীয় আদেশ নয়, এটি এক অমূল্য মানবিক কর্তব্য। আমাদের উচিত যতদিন তারা জীবিত, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এবং সহানুভূতি প্রদর্শন করা। কুরআন, হাদিস এবং ইসলামের ইতিহাস আমাদের পিতা-মাতার প্রতি দায়িত্বশীল হতে শেখায়। আমাদের সমাজের প্রতিটি সদস্যকে সচেতন হতে হবে, যেন আমাদের পরিবার, সমাজ এবং জাতি একটি সুন্দর ভবিষ্যত গড়ে তুলতে পারে। আমাদের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হল—যতদিন আমাদের পিতা-মাতা জীবিত, ততদিন আমরা তাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে পারি, এবং তাদের সেবা করার মাধ্যমে নিজেদের জীবনকে আরও আলোকিত করে তুলতে পারি। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে এই মহান দায়িত্ব পালনে সফলতা দান করুন।