||মুফতি নূর মুহাম্মদ রাহমানী||
মহানবী (সা.) ছিলেন উন্নত চরিত্রের অধিকারী। তাঁর উন্নত সুষমামণ্ডিত চরিত্র-মাধুর্যের বিবরণ দিয়ে আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেন, ‘নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রের ওপর অধিষ্ঠিত।’ (সুরা কলম : ৪)। তাঁর চরিত্র ছিল কোরআনেরই নমুনা। উন্নত সব চরিত্র ও উত্তম স্বভাবের সমন্বয়ে তিনি শ্রেষ্ঠ মানব। তাঁর জীবন আমাদের আদর্শ। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহর রাসুলের জীবনে রয়েছে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ।’ (সুরা আহজাব : ২১)। নবীজির পুরোটা জীবনই সুন্দর। সবার সঙ্গেই তিনি উত্তম আচরণ করতেন।
আর স্ত্রীদের সঙ্গে আচরণের ক্ষেত্রে তো তিনি ছিলেন আদর্শ পুরুষ। তিনি তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতেন। উত্তম আচরণ করতেন এবং উত্তম আচরণের তাগিদ দিতেন। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে ওই ব্যক্তি উত্তম যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম। আমি আমার স্ত্রীর কাছে তোমাদের চাইতে উত্তম।’ (তিরমিজি : ৩৮৯৫)। বিদায় হজের ঐতিহাসিক ভাষণেও তিনি স্বতন্ত্রভাবে উচ্চারণ করেছেন, ‘আমি তোমাদেরকে স্ত্রীদের সঙ্গে ভালো আচরণের উপদেশ দিচ্ছি।’ (তিরমিজি : ১০৮৩)
স্ত্রীদের সময় দেওয়া : মহানবী (সা.) সব স্ত্রীদের প্রতিদিন নিয়মিত সময় দিতেন। দিনের শুরুতে সবার কাছে একটা চক্কর দিতেন। সবাইকে সালাম দিতেন, খোঁজখবর নিতেন ও কুশল বিনিময় করতেন। তাদের জন্য দোয়া করতেন। আসরের পর আরও একবার সবার কাছে যেতেন। কাছাকাছি বসতেন। অন্তরঙ্গ হতেন।
আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) যখন আসর নামাজ থেকে অবসর হতেন, তখন তাঁর স্ত্রীদের গৃহে প্রবেশ করতেন, তাদের মধ্য হতে কারও অন্তরঙ্গ হতেন।’
(বুখারি : ৫২১৬)। হাদিসের ব্যাখ্যাকারগণ বলেছেন, এখানে অন্তরঙ্গ হওয়া দ্বারা উদ্দেশ্য হলো চুম্বন করা ও সাধারণ আনন্দ করা। অন্য কিছু নয়। (উমদাতুল কারি : ৩০/৯২)।
কারণ অন্য একটি হাদিসে রয়েছে, আয়েশা (রা.) বলেন, ‘অধিকাংশ সময় তিনি আমাদের সবার কাছে আসতেন এবং সঙ্গম ব্যতীতই সবার সঙ্গে অন্তরঙ্গ হতেন। অবশেষে যার নিকট রাত যাপনের পালা হতো তিনি তার কাছে রাত যাপন করতেন।’ (আবু দাউদ : ২১৩৫)
ভালোবাসা ও অন্তরঙ্গতা : মহানবী (সা.) স্ত্রীদের খুব ভালোবাসতেন। এমনকি একপাত্র থেকে পানি পান করতেন। একপাত্র থেকে গোসল করতেন। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘আমি মাসিক অবস্থায় পানি পান করতাম এবং পরে নবীকে (সা.) অবশিষ্টটুকু প্রদান করলে আমি যেখানে মুখ লাগিয়ে পান করতাম তিনিও পাত্রের সে স্থানে মুখ লাগিয়ে পান করতেন। আবার আমি মাসিক অবস্থায় হাড় খেয়ে তা নবীকে (সা.) দিলে আমি যেখানে মুখ লাগিয়েছিলাম তিনি সেখানে মুখ লাগিয়ে খেতেন।’ (মুসলিম : ৩০০)। অন্য একটি বর্ণনায় আয়েশা (রা.) বলেন, ‘আমি এবং রাসুল (সা.) একই পাত্র থেকে গোসল করতাম। তিনি আমার পূর্বে পানি নেওয়ার জন্য তাড়াতাড়ি করতেন, আমি তাঁর পূর্বে নেওয়ার জন্য তাড়াহুড়া করতাম। এমনকি তিনি বলতেন, আমার জন্য একটু পানি রাখ, আর আমি বলতাম, আমার জন্য একটু পানি রাখুন।’ (বুখারি : ১৩৮৯)
বিনম্র আচরণ করা : মহানবী (সা.) স্ত্রীদের সঙ্গে নম্র আচরণ করতেন। কঠোরতা করতেন না। ভর্ৎসনা কিংবা তিরস্কার করতেন না। কথায় কথায় ধমক দিতেন না। আত্মমর্যাদায় আঘাত দিতেন না। রাগ করতেন না। তাদেরকে কোনো বিষয়ে কটাক্ষ করে কথা বলতেন না। বরং হৃদয় উজাড় করে দিয়ে মায়া ও মম জুড়ানো আকর্ষণীয় ভাবভঙ্গি নিয়ে কথা বলতেন। তিনি স্ত্রীদের প্রতি কোমল আচরণের উপদেশ দিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, ‘তোমরা নারীদের উত্তম নসিহত প্রদান করবে। কেননা নারী জাতিকে পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। আর পাঁজরের হাড়গুলোর মধ্যে উপরের হাড়টি বেশি বাঁকা। তুমি যদি তা সোজা করতে যাও, তা হলে তা ভেঙে যাবে আর যদি ছেড়ে দাও, তা হলে সবসময় তা বাঁকাই থাকবে। কাজেই নারীদের নসিহত করতে থাক।’ (বুখারি : ৩৩৩১)
স্ত্রীদের প্রহার নয় : মহানবী (সা.) কখনও স্ত্রীদের প্রহার করতেন না। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) স্বহস্তে কোনোদিন কাউকে আঘাত করেননি, কোনো নারীকেও না, খাদেমকেও না, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ ব্যতীত।’ (তিরমিজি : ১০৮২)। মহানবী (সা.) স্ত্রীদের দোষত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখতেন। ত্রুটিগুলো না দেখে ভালো ও ইতিবাচক দিকগুলো দেখতেন। তিনি বলেছেন, ‘কোনো মুমিন পুরুষ তার স্ত্রীর প্রতি বিদ্বেষ-ঘৃণা পোষণ করবে না; তার কোনো চরিত্র অভ্যাসকে অপছন্দ করলে তার অন্য কোনো চরিত্র-অভ্যাস পছন্দনীয় হয়ে থাকবে।’ (মুসলিম : ২৬৭২)
স্ত্রীদের পরিবারের সঙ্গে ব্যবহার : মহানবী (সা.) স্ত্রীদের সঙ্গে যেমন ভালো ব্যবহার করেছেন, তেমনি স্ত্রীদের আত্মীয়, পরিবার-পরিজনের সঙ্গেও ভালো ব্যবহার করেছেন। হজরত আবু জর গিফারি (রা.) থেকে বর্ণিতÑ তিনি বলেন, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘শিগগিরই তোমরা মিসর বিজয় লাভ করবে। সেটা এমন একটি দেশ, যেখানের মুদ্রা ‘কিরাত’ নামে খ্যাত। তোমরা যখন সে দেশ বিজয় লাভ করবে তখন সেখানকার অধিবাসীদের সঙ্গে উত্তম ব্যবহার করবে। কারণ তাদের জন্য দায়িত্ব ও আত্মীয়তার সম্পর্ক বিদ্যমান রয়েছে। কিংবা তিনি বলেছেন, জিম্মাদারি ও বৈবাহিক সম্পর্ক রয়েছে।’ (মুসলিম : ২৫৪৩)। নবীজির এক স্ত্রী ছিলেন মুসা (আ.)-এর ভাই হারুন (আ.)-এর বংশধর। সে হিসেবে মিসরে নবীজির আত্মীয়-স্বজন রয়েছে। আরও অনেকের সঙ্গেই এভাবে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল।
আবেগ-অনুভূতি খেয়াল রাখা : মহানবী (সা.) স্ত্রীদের অনুভূতির প্রতি খুব গুরুত্ব দিতেন। তাদের আবেগ-অনুভূতি গভীর দৃষ্টিতে খেয়াল রাখতেন ও মূল্যায়ন করতেন। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিতÑ হাদিসে এসেছে, নবীজি (সা.) একদিন আমাকে বললেন, ‘আমি জানি কখন তুমি আমার প্রতি খুশি থাক এবং কখন
রাগান্বিত হও।’ আমি বললাম, কী করে আপনি তা বুঝতে সক্ষম হন? নবীজি বললেন, তুমি আমার প্রতি খুশি থাকলে বল, ‘মুহাম্মদ (সা.)-এর রবের কসম!’ কিন্তু তুমি আমার প্রতি নারাজ থাকলে বল, ‘ইবরাহিম (আ.)-এর রবের কসম!’ শুনে আমি বললাম, আপনি ঠিকই বলেছেন। আল্লাহর কসম, হে আল্লাহর রাসুল! সে ক্ষেত্রে শুধু আপনার নাম উচ্চারণ করা থেকেই বিরত থাকি।’
(বুখারি : ৫২২৮)
গৃহস্থালির কাজে স্ত্রীদের সহায়তা : মহানবী (সা.) গৃহস্থালির কাজে স্ত্রীদের সহযোগিতা করতেন। এটাকে কোনো লজ্জার কারণ মনে করতেন না।
আসওয়াদ (রা.) বর্ণনা করেন, ‘আমি আয়েশাকে (রা.) জিজ্ঞেস করলাম, রাসুল (সা.) গৃহে কী কাজ করতেন? তখন তিনি বললেন, তিনি তার স্ত্রীর কাজে ব্যস্ত থাকতেন, যখন নামাজের সময় হতো, নামাজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যেতেন।’ (বুখারি : ৬৭৬)
লেখক : শিক্ষাসচিব ও উস্তাজুল হাদিস জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলুম বাগে জান্নাত
চাষাড়া, নারায়ণগঞ্জ।