মানুষ মায়ের পেট থেকে দীক্ষা ও তারবিয়ত নিয়ে জন্ম লাভ করে না। দুনিয়াতে আগমনের পরই তাকে শিক্ষা-দীক্ষা দেওয়া হয়। এর যাবতীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য থাকে অভিভাবকদের উপর। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই এর জন্য, একেবারে অনপোযোগী পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। মনে করা হয়, রুক্ষতা ও কঠোরতা দীক্ষা ও তারবিয়তের ক্ষেত্রে সহায়ক। কিন্তু তা মোটেই ঠিক নয়। রুক্ষতা ও কঠোরতার দ্বারা শিক্ষার্থী ও শিশু-কিশোরদের দমিয়ে দেয়া যায়। তাদেরকে স্তব্ধ ও নিস্পন্দন করে দেয়া যায়। একে তারবিয়ত বলে না। একে দীক্ষা বলে না। বাস্তবে তারবিয়ত ও দীক্ষা হচ্ছে, শিশু-কিশোরদের সুপ্ত প্রতিভা বিকশিত হতে সাহায্য করা। তাদেরকে পেখম মেলে উড়তে সাহয্য করা।
আল্লাহ তায়ালা মানুষের মাঝে অসংখ্য প্রতিভা সুপ্ত রেখেছেন। এ প্রতিভাগুলো অতি সংবেদনশীল ও নাজুক। খুবই অনুভূতীপ্রবণ। একেবারেই সদ্য অস্ফুটিত চারা গাছের মত কোমল। এর পরিপূর্ণ বর্ধন ও পুরোপুরি বিকাশের জন্য প্রয়োজন আবশ্যকীয় পরিচর্যা। আরো প্রয়োজন খোলা আকাশের আলো ও মুক্ত বাতাস। আলোহীন বদ্ধ ঘরে, বাতাসহীন রুদ্ধ দারে চারা গাছ যেভাবে হলদে হয়ে শুকিয়ে অকালে মৃত্যু বরণ করে, সেভাবে স্তব্ধ ও নিস্পন্দন মানুষের মধ্যে প্রতিভাগুলো শুকিয়ে অকালেই মৃত্যু বরণ করে। তাই শিক্ষার্থী ও শিশু-কিশোরদের যথাযথ ও স্বতঃস্ফূর্ত মানসিক বিকাশে শিক্ষক ও তারবিয়তকারীর কোমল আচরণের বিকল্প নেই।
কোমলতা দ্বারা মানুষের আচার-আচরণ ও কথাবার্তা সুন্দর হয়। আর কোমল আচরণ ও সুন্দর ব্যবহার মানুষের মনে যে প্রভাব বিস্তার করে তা অন্য কোন উপায়ে সম্ভব নয়। এটি কেবল শিক্ষার্থী বা শিশু-কিশোরদের বেলাই নয়, বরং যে কোন স্তরের, যে কোন বয়সের তারবিয়ত গ্রহণকারীর ক্ষেত্রেই কোমলতা ও নম্রতা বেশ কার্যকর ও অত্যন্ত ফলপ্রসূ।
নববী জীবনে এর অসংখ্য জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত বিদ্যমান। কথা ও কাজ উভয় মাধ্যমেই তিনি বিষয়টি উম্মতের সামনে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন- “যে বিষয়ই কোমলতা থাকবে তা হবে সুন্দর্যমণ্ডিত। আর যে বিষয় কোমলতা শূন্য হবে তা হবে কলঙ্কিত।” [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৫৯৪]। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ হাদীসে নম্রতা ও কোমলতার চূড়ান্ত ফলাফল চমৎকারভাবে উম্মতের সামনে তুলে ধরেছেন।
শাইখ আবদুল ফাত্তাহ আবূ গুদ্দাহ হালবী রহ. বলেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাঝে নম্রতা ও কোমলতা, তিরস্কার না করা, সহজ পছন্দ করা, শিক্ষার্থীর সাথে কোমল আচরণ করা এবং উপযুক্ত স্থান-কাল বিবেচনা করে শিক্ষা দেয়ার গুণ পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান ছিল। আল্লাহ তায়ালার ইরশাদ- “তোমদের মাঝে তোমাদের থেকেই রাসূল আগমন করেছেন। তোমাদের কষ্টের বিষয়গুলো তার জন্য কষ্টদায়ক, তোমাদের কল্যাণে আগ্রহী, মুমিনদের প্রতি দয়াদ্র ও কোমল।” [সূরা- তাওবা : ১২৮।;আর-রাসূলুল মুআল্লিম ওয়া আসালীবুহু ফিততালীম, পৃ : ২১]
হযরত মুবিয়া ইবনুল হাকাম আসসুলমী রা. বলেন, একদা আমি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে নামাযরত ছিলাম। উপস্থিত কেউ হাঁচি দিল। আমি “ইয়ার হামুকাল্লাহ” বল্লাম। এতে অন্য মুসল্লিরা আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাতে লাগল। আমি বল্লাম, হায়! আমার ধ্বংস! তোমরা আমার প্রতি এভাবে তাকাচ্ছ কেন? এতে তারা তাদের উরুতে চাপড় দিয়ে আমাকে নিবৃত্ত করতে চাইল। তা বুঝে আমি চুপ হয়ে গেলাম। আমার পিতা-মাতা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য উৎসর্গ! কোন শিক্ষককে তার চেয়ে উত্তম পদ্ধতিতে শিক্ষা দিতে আমি দেখিনি! না তার পূর্বে না তার পরে। আল্লাহর শপথ! নামায শেষে তিনি আমাকে কোন ধমক দিলেন না! প্রহার করলেন না! এমনকি কোন কটু বাক্যও বললেন না! কেবল বললেন- “এ নামাযে জাগতিক কথাবার্তা বলা যায় না!” [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৫৩৭]
প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রুচিবোধ ছিল নম্রতা ও কোমলতা। ফলে তাঁর কাছ থেকে সব শ্রেণীর সব বয়সের সাহাবাগণই সহজে তারবিয়ত গ্রহণ করতে সক্ষম হয়ে ছিলেন। কোরআনুল কারীমে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন,“আল্লাহর দয়ায় আপনি তাদের জন্য কোমল হয়েছেন। আপনি যদি রূঢ় প্রকৃতির ও কঠোর হৃদয় হতেন, তবে তারা আপনার আশপাশ থেকে সরে গিয়ে বিক্ষিপ্ত হয়ে যেত। সুতরাং তাদের ক্ষমা করুন, তাদের জন্য আল্লাহর কাছে মাগফিরাতের দোয়া করুন এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাদের সাথে পরামর্শ করতে থাকুন। আর যখন কোন বিষয়ে সংকল্পবদ্ধ হবেন তো আল্লাহর উপর নির্ভর করুন। নিশ্চয় আল্লাহ তাওয়াক্কুলকারীদের ভালবাসেন।” [সূরা আল-ইমরান : ১৫৯]
এ আয়াতে তাবলীগ ও দ্বীন প্রচার এবং তারবিয়ত ও সংশোধনের বিষয়ে মূলনীতি পর্যায়ের দিকনির্দেশনা পাওয়া গেল। সুতরাং প্রত্যেক মুবাল্লিগ ও শিক্ষককে কোমলতা ও ক্ষমাশীলতা এবং নম্রতা ও উত্তম আচরণের গুণে গুণান্বিত হতে হবে। তবেই তাঁর তাবলীগ ও তারবিয়ত ফলপ্রসূ ও উপকারী হবে।
উল্লেখ্য, প্রাচীন যুগ থেকেই সংশোধন ও শাসন শিক্ষা ও তারবিয়তের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে পরিগণিত। তাই মাঝে মধ্যে যদি শাসনের প্রয়োজন হয়, তাও কোমলতা ও নম্রতার সাথেই হওয়া বাঞ্ছনীয়। ইসলাম সব ক্ষেত্রেই কোমলতা ও নম্রতার নির্দেশ দেয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন “আল্লাহ তায়ালা সব ক্ষেত্রেই কোমলতা আবশ্যক করেছেন। সুতারাং তোমরা যখন হত্যা করবে তো উত্তমভাবেই হত্যা করবে। আর যখন জবাই করবে তো উত্তমভাবেই জাবাই করবে। ছুরি ধার দিয়ে নিবে এবং জাবাইকৃত প্রাণীকে অবকাশ দিবে।” [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং : ১৯৫৫] যেখানে জবাই ও হত্যার ক্ষেত্রে ইসলাম কোমলতা ও নম্রতার নিদের্শ দেয় সেখানে শিক্ষার্থী ও তারবিয়তগ্রহণকারীর শাসন তো আরো বেশি পরিমাণ কোমলতা ও নম্রতার সাথে হওয়া উচিৎ। “লাঠির মাঝে ধরুন”!!
কারো ভুল-ত্রুটি প্রকাশ পেলে তাকে সতর্ক ও সংশোধন করা তারবিয়তকারীর দায়িত্ব। তবে এক্ষেত্রেও কোমলতা অবলম্বন করা হলে, তা বেশ কার্যকর ও ফলপ্রসূ হয়। ভুল শুধরিয়ে দেয়ার সময় তাকে লাঞ্ছিত না করে, তার ভাল কোন দিক উল্লেখ করে বা প্রসংশা জ্ঞাপক কোন কথা বলে ভুলটি তার সম্মুখে তুলে ধরা। এতে সে মনক্ষুন্ন না হয়ে বরং উৎসাহিত হবে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমনটিই করতেন। তিনি আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা.-কে তাহাজ্জুদ না পড়ার বিষয়ে সতর্ক করার ইচ্ছা করলেন। বললেন,“আবদুল্লাহ তো খুব ভাল মানুষ! যদি সে তাহাজ্জুদ পড়ত! (তবে আরো ভালো হত!)।” [সহীহ বুখারী, হাদীস নং : ১১২২।] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই কোমল সতর্কবাণীর ফলে আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. তাহাজ্জুদে অভ্যস্ত হয়ে গেলেন!!
খালিদ ইবনুল ওয়ালিদ রা. ইসলামের পূর্ব থেকেই বীর-বাহাদুর ও জ্ঞানী ছিলেন। জ্ঞানী হওয়া সত্ত্বেও ইসলাম গ্রহণ না করা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দৃষ্টিতে খালিদ রা. ভুল ছিল। তাই তিনি খালিদ রা.কে এ ভুল সম্পর্কে সতর্ক করার ইচ্ছা করলেন। হুদায়বিয়ার সন্ধির পরবর্তী বছর, ওমরা আদায়ের জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা মুকাররামায় পৌঁছলেন। সাথে খালিদ রা.এর ভাই ওয়ালিদ ইবনুল ওয়ালিদ ছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “খালিদ কোথায়??” ওয়ালিদ রা. বললেন, ইয়ারাসূলাল্লাহ! আল্লাহ তাকে হেদায়েত দান করুন! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “খালিদের মত ব্যক্তিও ইসলাম গ্রহণ না করে থাকতে পারে! সে তার বীরত্ব ও শক্তি যাদি মোসলমানদের সাথে জুড়ে দিত তবে তার কল্যাণ হতো। সে ইসলাম গ্রহণ করলে আমরা তার যথাযথ মূল্যায়ন করতাম! অন্যদের চেয়ে তাকেই প্রাধান্য দিতাম!” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এমন কোমল সতর্কবাণী ও উৎসাহের বাক্য শুনে খালিদ রা. আর স্থির থাকতে পারলেন না! দ্রুত মদীনায় গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করলেন! (দালাইলুন নাবুওয়াহ লিলবায়হাকী, হাদীস নং ১৬৮৫)। হ্যাঁ, তারবিয়ত ও দীক্ষা কোমল হলে যাদুর মতই কাজ হয়!
আমীর হামযাহ
মুহাদ্দিস, জামিয়াতু ইবরাহীম
hamzah.amir71@gmail.com