অনেকের মানসিকতা হলো, সব সম্পদ ওয়ারিসদের কাউকে না দিয়ে অন্য কোথাও দান করে দেওয়া। অনেকেই বৃদ্ধ বয়সে এসে যখন দেখেন মৃত্যু খুব কাছাকাছি তখন মনে করেন সন্তানের জন্য সম্পদ রেখে কী লাভ? ফলে পুরা সম্পদ দান করে দেন। এটি শরীয়তের ভারসাম্যপূর্ণ উত্তরাধিকার ও বণ্টননীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যশীল নয়। দেখুন, পবিত্র কুরআনের বর্ণনা অনুযায়ী কারুনকে মূসা আ. নসীহত করে বলেছেন–
وَ لَا تَنْسَ نَصِیْبَكَ مِنَ الدُّنْیَا وَ اَحْسِنْ كَمَاۤ اَحْسَنَ اللهُ اِلَیْكَ.
এবং দুনিয়া থেকে তোমার অংশ ভুলো না; তুমি অনুগ্রহ কর যেমন আল্লাহ তোমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। –সূরা কাসাস (২৮) : ৭৭
অর্থাৎ তোমার দুনিয়ায় চলার জন্য যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু তুমি হাতে রাখ। বাকিটুকু দান কর। আবেগ নিয়ে পুরো সম্পদ দিয়ে দেওয়া, নিজের জন্য, নিজের পরিবারের জন্য কোনো সম্পদ না রাখা– এটা শরীয়তের দৃষ্টিতে কোনো পছন্দনীয় কাজ নয়।
অপর আয়াতে এসেছে—
وَالَّذِينَ إِذَا أَنفَقُوا لَمْ يُسْرِفُوا وَلَمْ يَقْتُرُوا وَكَانَ بَيْنَ ذَلِكَ قَوَامًا
এবং তারা যখন ব্যয় করে, তখন অযথা ব্যয় করে না কৃপণতাও করে না এবং তাদের পন্থা হয় এতদুভয়ের মধ্যবর্তী, ভারসম্যপূর্ণ। [ সুরা ফুরকান ২৫:৬৭]
অন্য আয়াতে এসেছে-
وَلاَ تَجْعَلْ يَدَكَ مَغْلُولَةً إِلَى عُنُقِكَ وَلاَ تَبْسُطْهَا كُلَّ الْبَسْطِ فَتَقْعُدَ مَلُومًا مَّحْسُورًا
তুমি একেবারে ব্যয়-কুষ্ঠ হয়োনা এবং একেবারে মুক্ত হস্তও হয়ো না। তাহলে তুমি তিরস্কৃতি, নিঃস্ব হয়ে বসে থাকবে। [ সুরা বনী-ইসরাঈল ১৭:২৯ ]
অপর এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,
عَنْ عَامِرِ بْنِ سَعْدٍ، عَنْ أَبِيهِ، قَالَ: جَاءَنَا رَسُولُ اللَّهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَعُودُنِي مِنْ وَجَعٍ اشْتَدَّ بِي، زَمَنَ حَجَّةِ الوَدَاعِ، فَقُلْتُ: بَلَغَ بِي مَا تَرَى، وَأَنَا ذُو مَالٍ، وَلاَ يَرِثُنِي إِلَّا ابْنَةٌ لِي، أَفَأَتَصَدَّقُ بِثُلُثَيْ مَالِي؟ قَالَ: لاَ قُلْتُ: بِالشَّطْرِ؟ قَالَ: لاَ قُلْتُ: الثُّلُثُ؟ قَالَ: الثُّلُثُ كَثِيرٌ، أَنْ تَدَعَ وَرَثَتَكَ أَغْنِيَاءَ خَيْرٌ مِنْ أَنْ تَذَرَهُمْ عَالَةً يَتَكَفَّفُونَ النَّاسَ، وَلَنْ تُنْفِقَ نَفَقَةً تَبْتَغِي بِهَا وَجْهَ اللَّهِ إِلَّا أُجِرْتَ عَلَيْهَا، حَتَّى مَا تَجْعَلُ فِي فِي امْرَأَتِكَ
হযরত আমের ইবনে সাদ তাঁর বাবা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, বিদায় হজ্বের সময় আমার এক কঠিন পীড়ায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে দেখতে আসেন। তখন আমি বললাম, আমার মুমূর্ষ অবস্থা তো আপনি দেখছেন, এদিকে আমার অনেক সম্পদ আছে। আর আমার একমাত্র ওয়ারিস আমার মেয়েই। আমি কি আমার সম্পদের দুই তৃতীয়াংশ (গরীবদেরকে) সদকা করে দেবো? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, না। আমি বললাম, তাহলে অর্ধেক? নবীজী বললেন, না। এক তৃতীয়াংশ? নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এক তৃতীয়াংশ এবং এক তৃতীয়াংশও অনেক। নিশ্চয়ই তুমি যদি তোমার ওয়ারিসদেরকে স্বচ্ছল রেখে যাও তাহলে সেটা উত্তম হবে তাদেরকে এমন দরিদ্র রেখে যাওয়ার চেয়ে যে, তারা মানুষের কাছে হাত পাতবে। তুমি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্যেশ্যে যা ব্যয় করবে তার উত্তম প্রতিদান পাবে। এমনকি স্বীয় স্ত্রীর মুখে তুলে দেওয়া লোকমার বিনিময়েও। -[সহীহ বুখারী :১২০]
এ হাদীসে দেখা যাচ্ছে, এক তৃতীয়াংশ দান করার বিষয়টিকেও রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেশি হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। অর্থাৎ দান করলে এক তৃতীয়াংশ বা তার চেয়ে কম করা যেতে পারে। এখান থেকে ফকীহগণ বলেন, অসিয়ত সমুদয় সম্পদের এক তৃতীয়াংশের কিছু কম হতে হবে। এ হাদীসের শেষাংশে একটি বাক্য রয়েছে যেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই তুমি যদি তোমার ওয়ারিসদেরকে স্বচ্ছল রেখে যাও তাহলে সেটা উত্তম হবে তাদেরকে এমন দরিদ্র রেখে যাওয়ার চেয়ে যে, তারা মানুষের কাছে হাত পাতবে।’ এ বাক্যের মর্মার্থ হল, উত্তরাধিকারীদেরকে রিক্তহস্ত রেখে, পুরোপুরি বঞ্চিত রেখে সব সম্পদ দান করে দেওয়া উত্তম নয়, উচিত নয়।
এ হাদীস থেকে এ কথাও স্পষ্ট যে, ইসলামে বৈরাগ্য নেই। ধন-সম্পদ সব দান করে দিলাম– এটা ঠিক নয়। এই হাদীসের ব্যাখ্যা অন্য বহু হাদীসেও পাওয়া যায়। নিজের পরিবারের জন্য খরচ করাকেও হাদীস শরীফে সদাকা হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। এধরনের অন্য একটি হাদীসে বলা হয়েছে,
حَتَّى اللُّقْمَةُ تَجْعَلُهَا فِي فِي امْرَأَتِكَ
এমনকি সেই খাবারের লোকমা যা তুমি তোমার স্ত্রীর মুখে তুলে দিচ্ছ (সেটিও সদাকা) –[সহীহ মুসলিম, : ২৬২৮]
এই হাদীসে আরেকটি দিকে ইশারা রয়েছে। সব সহায়-সম্পদ যে কেবল পরিবার-পরিজনের জন্য রেখে যেতে হবে এমনও নয়। বরং কিছু সম্পদ দ্বীনের পথে অথবা আর্তপীড়িত মানুষদের জন্য অসিয়্যত কিংবা ওয়াক্ফ করে যাবে। ইনসাফপূর্ণ শোষণমুক্ত মুসলিম সমাজ বিনির্মাণে একসময় ওয়াকফ ও অসিয়্যত বড় ভূমিকা রেখেছে। সঠিক দ্বীনী চিন্তা-চেতনা বিলুপ্ত হওয়ার কারণে এখন ব্যাপকভাবে ওয়াক্ফ ও অসিয়্যতের ধারা সেভাবে রক্ষিত হয় না। অথচ শোষণমুক্ত ইসলামী অর্থ-ব্যবস্থার জন্য শুধু যাকাত নয়, ওয়াক্ফ ও অসিয়্যতের ভূমিকাও অনেক বড়।
অপর হাদীসে এসেছে-
عَنْ كَعْبِ بْنِ مَالِكٍ رضي الله عنه قَالَ قُلْتُ : يَا رَسُولَ اللَّهِ , إنَّ مِنْ تَوْبَتِي : أَنْ أَنْخَلِعَ مِنْ مَالِي , صَدَقَةً إلَى اللَّهِ وَإِلَى رَسُولِهِ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم : “ أَمْسِكْ عَلَيْكَ بَعْضَ مَالِكَ فَهُوَ خَيْرٌ لَكَ “
কা’ব ইবনে মালেক রা. বলেন, আমি বললাম ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার তওবার একটি দিক হলো, আমি সকল সম্পদ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সন্তুষ্টির) জন্য সদকা করে সকল সম্পদ থেকে মুক্ত হয়ে যাব। উত্তরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, সম্পদের কিছু অংশ রেখে দাও, তা তোমার জন্য শ্রেয়। [সহীহ বুখারী : ২৫৫২, সহীহ মুলিম : ৪৯৭৩]
উত্তরসরীদেরকে সাবলম্বী রাখা জরুরী
জীবদ্দশায় সন্তানদের খরচাদি দেওয়ার পাশাপাশি উত্তরাধিকারীদের সাবলম্বী রেখে যাওয়ার প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত সা‘দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রা. কে বলেন,
إِنَّكَ أَنْ تَدَعَ وَرَثَتَكَ أَغْنِيَاءَ خَيْرٌ مِنْ أَنْ تَدَعَهُمْ عَالَةً يَتَكَفَّفُونَ النَّاسَ فِي أَيْدِيهِمْ
“তোমার সন্তান-সন্ততিদেরকে দরিদ্র, অভাবী ও ভিক্ষুক অবস্থায় রেখে যাওয়ার চেয়ে, স্বচ্ছল ও সম্পদশালী রেখে যাওয়া শ্রেয়।” (বুখারী হাদীস নং ২৫৯১, ২৭৪২।)
আলোচিত আয়াত ও হাদীস হতে স্পষ্টভাবে একথা প্রমাণ হয় যে, আপন স্ত্রী-সন্তান, পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনদের হক্ব ও দায়িত্ব আদায় করা অপরিহার্য। অধিনস্তদের খাদ্য-বস্ত্র ও আবাসন ব্যবস্থা ধর্মীয়ভাবে ব্যক্তির উপর বর্তায়। আর এ সমস্ত দায়িত্ব আদায়ে উপার্জন আবশ্যকীয়। তাছাড়া উত্তরাধিকারীদের সাবলম্বী ও সচ্ছল রেখে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। কারণ আর্থিক অস্বচ্ছলতার কোন পর্যায়ে সম্পদের প্রয়োজন মিটাতে অপরের দারস্থ হতে হয়। অথচ পরনির্ভরতায় ইসলাম মানুষকে নিরুৎসাহিত করেছে।
তবে যদি ব্যক্তি সুস্থ অবস্থায়, স্ব জ্ঞানে, স্ব ইচ্ছায় সব সম্পদ দান করে দেয় তাহলে তা কার্যকর হয়ে যাবে, যদিও শরীয়ত এতে নিরুৎসাহিত করে। অপছন্দ করে।