আমীর হামযাহ
সন্তান মানুষ জীবনের এমন একটি প্রপ্তি, যা কেবল আল্লাহর দান। এই দান একটি বিশেষ আমানত, যা সঠিকভাবে পালন করা অভিভাবকদের উপর আল্লাহর পক্ষ থেকে দায়িত্ব। নিঃসন্তান দম্পতির হৃদয়ে সন্তানের অভাব যেমন একটি গভীর শূন্যতার সৃষ্টি করে, তেমনি সন্তানের সঠিক লালন-পালনে অভিভাবকের ব্যর্থতা হতে পারে সমাজের জন্য ক্ষতিকর। ইসলাম সন্তান লালন-পালনের জন্য সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা দিয়েছে, যা অনুসরণ করলে একটি সুশৃঙ্খল ও সৎ সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
আল্লাহর দান ও সন্তানের গুরুত্ব
আল্লাহ তাআলা বলেন:
“আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর রাজত্ব আল্লাহরই। তিনি যা চান সৃষ্টি করেন। যাকে চান কন্যা দেন এবং যাকে চান পুত্র দেন। অথবা দান করেন পুত্র ও কন্যা উভয়ই। আবার যাকে ইচ্ছা বন্ধ্যা করে দেন। নিশ্চয়ই তিনি সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান।” – (সূরা শুরা: ৪৯-৫০)
সন্তান আল্লাহর পক্ষ থেকে নিআমত এবং তা আমাদের জন্য পরীক্ষা। আল্লাহ তাআলা বলেন:
“জেনে রেখ, তোমাদের সম্পদ ও তোমাদের সন্তান-সন্ততি তোমাদের জন্য এক পরীক্ষা। আর মহা পুরস্কার রয়েছে আল্লাহরই কাছে।” – (সূরা আনফাল: ২৮)
সন্তানকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার গুরুত্ব
ইসলামের দৃষ্টিতে সন্তানকে সঠিকভাবে লালন-পালন করা অভিভাবকের অন্যতম বড় দায়িত্ব। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন:
“তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেককেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। পুরুষ তার পরিবারের ব্যাপারে দায়িত্বশীল। নারী তার সন্তান-সন্ততির বিষয়ে দায়িত্বশীল।” – (সহীহ বুখারি, হাদিস: ৭১৩৮)
ইসলামের নির্দেশনা অনুযায়ী সন্তানকে সঠিক পথে পরিচালিত করা, তার আখলাক ও চরিত্র গঠন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শয়তান মানবশিশুকে ধ্বংস করতে চায় এবং তাদের বিপথে পরিচালিত করার চেষ্টা করে। এজন্য অভিভাবকদের সতর্ক থাকা এবং সন্তানের জীবন গঠনে যথাযথ ভূমিকা পালন করা অত্যন্ত জরুরি।
লালন-পালনের মূলনীতি
১. আল্লাহর কাছে দুআ করা
সন্তানের উত্তম ভবিষ্যতের জন্য পিতা-মাতার দুআ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নবীগণ তাঁদের সন্তানদের জন্য সর্বদা দুআ করতেন। ইবরাহীম (আ.) আল্লাহর কাছে দুআ করেছিলেন:
“হে আমার প্রতিপালক! আমাকেও নামায কায়েমকারী বানিয়ে দিন এবং আমার আওলাদের মধ্য হতেও (এমন লোক সৃষ্টি করুন, যারা নামায কায়েম করবে)।” – (সূরা ইবরাহীম: ৪০)
২. তাওহীদের শিক্ষা দেওয়া
শিশুকে শৈশব থেকেই আল্লাহর একত্ববাদ এবং শিরকমুক্ত বিশ্বাস শেখাতে হবে। লুকমান (আ.) তার ছেলেকে উপদেশ দিয়ে বলেন:
“হে বাছা! আল্লাহর সাথে শিরক করো না। নিশ্চয়ই শিরক চরম জুলুম।” – (সূরা লুকমান: ১৩)
৩. আখলাক ও চরিত্র গঠন
সন্তানের মনে সুন্দর স্বভাব ও আখলাকের বীজ বপন করা অভিভাবকের কর্তব্য। রাসূলুল্লাহ (সা.) শিশুদের প্রতি নম্র ও স্নেহশীল ছিলেন। তিনি বলেন:
“যে ব্যক্তি কন্যাসন্তান লালন-পালনের পরীক্ষায় নিপতিত হয় আর তাদের সঙ্গে সদাচরণ করে, তার জন্য এরা জাহান্নামের পর্দা হবে।” – (সহীহ মুসলিম, হাদিস: ৬৪৫৪)
৪. সৎ সংশ্রব নিশ্চিত করা
শিশুকে সৎ ও নেককার মানুষের সাথে সময় কাটাতে দেওয়া উচিত। আল্লাহ বলেন:
“তোমরা সত্যবাদীদের সাথে থাক।” – (সূরা তাওবা: ১১৯)
মন্দ পরিবেশ ও অসৎ সঙ্গ সন্তানের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। এজন্য অভিভাবকদের সতর্ক থাকতে হবে।
৫. শিশুর প্রতি দায়িত্বশীল আচরণ
শিশুর প্রতি স্নেহশীল ও দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। নবীজি (সা.) বলেন:
“আল্লাহ যদি বান্দাকে কারো দায়িত্বশীল বানান আর সে নিজ অধীনস্তদের কল্যাণের ব্যাপারে যত্নশীল না হয়, তাহলে সে জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না।” – (সহীহ বুখারি, হাদিস: ৭১৫০)
সন্তানকে ইসলামী শিক্ষা দেওয়ার পদ্ধতি
শিশুর কানে আযান দেওয়া
শিশুর জন্মের পর তার কানে আযান দেওয়া ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত। এতে আল্লাহর মহানত্ব ও তাওহীদের বার্তা শিশুর জীবনের শুরু থেকেই প্রবেশ করে।
সুন্দর নাম রাখা
সন্তানের জন্য একটি অর্থবহ ও সুন্দর নাম নির্বাচন করা পিতার কর্তব্য। নবীজি (সা.) বলেন:
“আজ রাতে আমার ঘরে একটি পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করেছে। আমি আমার দাদার নামানুসারে তার নাম রেখেছি ইবরাহিম।” – (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ৩১১২)
আদব-কায়দা শেখানো
শিশুকে ছোটবেলা থেকেই ইসলামী আদব-কায়দা শেখাতে হবে। যেমন খাবারের আগে বিসমিল্লাহ বলা, ডান হাতে খাওয়া, elders-এর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা ইত্যাদি।
কুরআন শিক্ষার গুরুত্ব
কুরআন শিক্ষা সন্তানের জীবনে অপরিহার্য। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন:
“যে ব্যক্তি কুরআন শরীফ পড়বে এবং এর উপর আমল করবে, তার পিতা-মাতাকে কিয়ামতের দিন এমন এক মুকুট পরানো হবে, যার আলো সূর্যের আলো থেকেও উজ্জ্বল।” – (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ১৪৪৮)
সমাজে দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী সন্তান গড়ে তোলা
সতর্কতার প্রয়োজন
অভিভাবকদের সতর্ক থাকতে হবে যেন সন্তান কখনো টিভি, মোবাইল, বা অন্য কোনো মাধ্যমের মাধ্যমে খারাপ প্রভাব না পায়।
অভিভাবকের দৃষ্টান্তমূলক আচরণ
সন্তানের জীবনে মা-বাবার দৃষ্টান্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মা-বাবা যদি নিয়মিত নামায পড়েন, দুআ করেন এবং সুন্নত মেনে চলেন, তাহলে সন্তানও তা অনুসরণ করবে।
প্রচলিত কিছু প্রশ্ন ও তাদের উত্তর
প্রশ্ন: সন্তানের প্রতি পিতার প্রথম কর্তব্য কী?
উত্তর: সন্তানের জন্মের পর তার কানে আযান দেওয়া এবং একটি সুন্দর নাম রাখা।
প্রশ্ন: কুরআন শিক্ষা কখন থেকে শুরু করা উচিত?
উত্তর: সাত বছর বয়স থেকেই সন্তানের কুরআন শিক্ষা শুরু করা উচিত।
প্রশ্ন: সন্তানের প্রতি দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে কী হবে?
উত্তর: কিয়ামতের দিন আল্লাহ পিতা-মাতাকে জিজ্ঞাসা করবেন তাদের সন্তানদের প্রতি তাদের দায়িত্ব পালনের বিষয়ে।
প্রশ্ন: শয়তানের প্রভাব থেকে সন্তানকে রক্ষা করার উপায় কী?
উত্তর: সন্তানের প্রতি দুআ করা, তাদের ইসলামী শিক্ষা দেওয়া এবং সৎ সঙ্গ নিশ্চিত করা।
উপসংহার
সন্তান লালন-পালন একটি মহান দায়িত্ব এবং ইসলাম এই বিষয়ে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে। প্রতিটি সন্তান আল্লাহর দান এবং আমানত। তাদের আখলাক, চরিত্র ও আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য অভিভাবকদের সচেতন হওয়া অত্যন্ত জরুরি। সন্তানকে সঠিকভাবে লালন-পালন করলে তারা একদিন সমাজের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে উঠবে এবং আখিরাতে পিতা-মাতার জন্য মুক্তির মাধ্যম হবে। আল্লাহ আমাদের সন্তানদের উত্তম মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার তাওফিক দান করুন। আমীন।