খালেদ আহমদ
বর্তমান সময়কে প্রযুক্তির যুগ বলা হয়। প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে প্রযুক্তি আমাদের জীবনকে ঘিরে রেখেছে। স্মার্টফোন, ট্যাবলেট, ল্যাপটপ, এবং ইন্টারনেটের অবাধ ব্যবহার মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু প্রযুক্তি যখন আমাদের প্রয়োজন মেটাতে আশীর্বাদ হয়, তখনই এর অতিরিক্ত ব্যবহার হয়ে উঠতে পারে অভিশাপ—বিশেষ করে শিশুদের জন্য।
শিশুরা যখন প্রযুক্তির প্রতি অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, তখন তাদের মানসিক, শারীরিক এবং সামাজিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি হয়। ছোটবেলা থেকেই তারা ভার্চুয়াল দুনিয়ার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে। তাদের মনন ও মূল্যবোধ নষ্ট হতে শুরু করে। তাই পরিবারের অভিভাবকদের দায়িত্ব, শিশুরা যেন প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারে অভ্যস্ত হয় এবং অতিরিক্ত ব্যবহার এড়িয়ে চলে।
শিশুদের প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহারের সমস্যাগুলো
১. স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি:
দীর্ঘ সময় ধরে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকার ফলে শিশুদের চোখের সমস্যা বৃদ্ধি পায়। তারা মাথাব্যথা, ঘাড়ব্যথা এবং স্থূলতার মতো সমস্যায় ভুগতে শুরু করে। ছোটবেলা থেকেই চোখে চশমা পড়ার প্রবণতা বাড়ছে, যা ভবিষ্যতে আরও জটিল স্বাস্থ্যগত সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
২. সামাজিক বিচ্ছিন্নতা:
প্রযুক্তির প্রতি অতিরিক্ত মনোযোগ শিশুকে বাস্তব জীবনের সামাজিক মিথস্ক্রিয়া থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। তারা পরিবার এবং বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানোর পরিবর্তে ভার্চুয়াল দুনিয়ায় হারিয়ে যায়। এর ফলে শিশুরা বাস্তব জীবনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অক্ষম হয়ে পড়ে।
৩. মানসিক চাপ ও উদ্বেগ:
ভিডিও গেমস এবং সোশ্যাল মিডিয়ার প্রতি অতিরিক্ত আসক্তি শিশুদের মানসিক স্থিতি নষ্ট করে। তারা হতাশা, উদ্বেগ এবং চাপের শিকার হয়। এমনকি ছোটখাটো বিষয়েও তারা অযথা উত্তেজিত বা হতাশ হয়ে পড়ে।
৪. পড়াশোনার প্রতি অনীহা:
প্রযুক্তিতে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করলে শিশুদের পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ কমে যায়। তারা পড়ার সময় ধৈর্য ধরে মনোযোগ দিতে পারে না। এভাবে শিক্ষার প্রতি উদাসীনতা তাদের ভবিষ্যতের জন্য বড় বিপদের কারণ হতে পারে।
৫. অনলাইন বিপদ:
শিশুরা প্রায়ই অনলাইনে অনুপযুক্ত কনটেন্টের মুখোমুখি হয়। এগুলোর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তারা ধীরে ধীরে নেতিবাচক মানসিকতা গড়ে তোলে। এটি তাদের নৈতিকতা এবং মূল্যবোধকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
শিশুদের প্রযুক্তি ব্যবহারে ভারসাম্য আনার উপায়
১. সময় নির্ধারণ:
শিশুরা কখন এবং কতক্ষণ প্রযুক্তি ব্যবহার করবে, তা নিয়ে পরিবারের পক্ষ থেকে একটি নির্দিষ্ট সময়সূচি তৈরি করা উচিত। তাদের স্ক্রিন টাইম সীমিত রাখতে হবে। প্রযুক্তির বাইরে তাদের খেলাধুলা এবং পারিবারিক সময়ে মনোযোগ দিতে উৎসাহিত করতে হবে।
২. শিক্ষামূলক কনটেন্ট উৎসাহিত করা:
শিক্ষামূলক অ্যাপ্লিকেশন, সৃজনশীল ভিডিও বা পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রযুক্তি ব্যবহারে শিশুদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
৩. প্রযুক্তিমুক্ত পারিবারিক সময়:
পরিবারের সদস্যরা একসঙ্গে প্রযুক্তিমুক্ত সময় কাটানোর ব্যবস্থা করতে পারেন। এটি হতে পারে একত্রে গল্প শোনা, রান্না করা, বা কোনো মজার খেলা খেলার মাধ্যমে।
৪. উদাহরণ স্থাপন:
বাবা-মা যদি নিজেরাই প্রযুক্তি ব্যবহারে সংযত থাকেন, তবে শিশুরাও তা অনুসরণ করবে। শিশুরা বড়দের দেখেই শেখে। পরিবারের বড়রা যদি প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার করে, তবে শিশুরাও তা গ্রহণ করবে।
৫. শারীরিক কার্যকলাপে উৎসাহ প্রদান:
শিশুকে বাইরের খেলাধুলা এবং শারীরিক কার্যকলাপে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এটি তাদের শুধু প্রযুক্তি থেকে দূরে রাখবে না, তাদের শারীরিক এবং মানসিক বিকাশেও সহায়ক হবে।
৬. নিরাপত্তা নিশ্চিত করা:
শিশুরা ইন্টারনেটে কী করছে, তা নজরদারি করা অত্যন্ত জরুরি। নিরাপদ ব্রাউজিং এবং অনলাইন কার্যকলাপের সীমা নির্ধারণ করতে হবে।
৭. পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করা:
ঘুমানোর আগে স্ক্রিন ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা উচিত। এটি তাদের ঘুমের মান উন্নত করবে এবং শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সহায়ক হবে।
শিশুদের সঙ্গে প্রযুক্তি নিয়ে খোলামেলা আলোচনা
শিশুদের প্রযুক্তি ব্যবহারের ভালো-মন্দ সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। তাদের বুঝাতে হবে, প্রযুক্তি সঠিকভাবে ব্যবহার করলে এটি উপকারী, কিন্তু অপব্যবহার করলে এটি তাদের ক্ষতির কারণ হতে পারে।
মোট কথা, পরিবারে শিশুদের প্রযুক্তি ব্যবহারের নিয়ন্ত্রণ শুধু তাদের সুরক্ষার জন্য নয়; এটি তাদের শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক বিকাশ নিশ্চিত করার জন্যও প্রয়োজনীয়। বাবা-মায়ের সচেতনতা এবং সঠিক নির্দেশনার মাধ্যমে শিশুরা প্রযুক্তিকে জীবনের একটি সহায়ক উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করতে শিখবে। তারা প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার করে নিজেদের জীবনের উন্নয়নে নিয়োজিত হবে এবং ভবিষ্যতে সমাজের একজন আদর্শ সদস্য হয়ে উঠবে।