মূল:শায়েখ আলী তানতাবী
ভাষান্তর: ছাকিবুল ইসলাম কাসেমী
প্রতিটি মুসলমানকে এটা মনে রাখা দরকার যে,রিযিক বণ্টিত ৷ অর্থাৎ তোমার জন্য বরাদ্দকৃত রিযিকটি যেমন নির্ধারিত ৷ আমার জন্য আমার রিযিকও অবধারিত ৷ তোমার রিযিক তুমি পাবেই ৷ আমার রিযিক আমি পাবোই ৷ এর কী এই অর্থ ? যে, আমি আর কিছু করবো না ? শুধু ঘরে বসে থাকব ? কর্মহীন সময় কাটাব? চেষ্টার ঘরে খিল এঁটে দিব? আমার জন্য যা বরাদ্দ আছে তাতো আসবেই ৷
না, এর এই অর্থ নয় ৷ বরং ব্যবসাকে শরীয়া সম্মতভাবে বাড়াতে হবে ৷ চাকরিতে সততার সাথে পদোন্নতির চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে ৷ নিজের চেষ্টা পূর্ণাঙ্গভাবে পেশ করতে হবে ৷ সম্ভাব্য সব পথে নিজেকে নিবেদন করতে হবে ৷ তারপর যা পাবে, তার উপর তুষ্ট থাকতে হবে ৷ এটাই হল বণ্টনের মর্ম ৷ নির্ধারিত ‘রিযিকভাগ্যে’ বিশ্বাসের অর্থ ৷
কিন্তু এই বিশ্বাস ও তৃপ্ত অনুভূতিকে কিভাবে ধারণ করবে মনের মধ্যে ? কিভাবে রেযা বিলকাযা তথা “মনিবের সিদ্ধান্তে ভৃত্যের তুষ্টি” এর অনবদ্য সম্পদে ঐশ্ব্যর্যমণ্ডিত হবে ? কবি সুন্দর বলেছেন: فالينظر إلي من فوقه أدبا والينظر إلي من دونه مالا উপরে তাকাবে? গুণে মানে যে বড় তোমার দেখ তাকে অর্থকড়িতে ছোট যে তোমার ভাব তাকে ৷ (দু:খ ক্ষোভের প্রহর খুঁচবে, হাসবে গোলাপ হৃদয়বাগে।)
শুদ্ধ ভাবনা তৃপ্ত জীবন
হ্যাঁ, এভাবে যারা ভাবতে পারে তারাই স্বস্তি ও তৃপ্তির প্রহর কাটাতে পারে ৷ অন্যথায় শুধু ক্ষোভ কষ্ট ও বিতৃষ্ণায় জীবন ভরে উঠে ৷ অথচ কোন ফায়দাও নেই তাতে ৷ যেমন, উঁচু পাহাড় ৷ অনেকেই আরোহণ করছে ৷ দেখা গেল, কিছু সময় পর কেউ চূড়ার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে ৷ কেউ অর্ধ পাহাড় পৌঁছেছে ৷ কেউ মাটির কাছাকাছিই রয়ে গেছে ৷ এখন যে মাঝামাঝি রয়ে গেছে সে যদি উপরে তাকায় কষ্ট পাবে ৷ আর যদি নিচে তাকায় তাহলে আনন্দ পাবে ৷ কেননা, সে অনেকের উপরে আছে ৷ হ্যাঁ, তবে যদি মনে সাহস সঞ্চারের জন্য উপরে তাকায়, তাহলে সমস্যা নেই ৷ কিন্তু শুধু আক্ষেপ আর কষ্ট পাওয়ার জন্য এমন করাটা বোকামি বৈ কিছুই নয়!
তাই চেষ্টা অব্যাহত থাকবে ৷ শরয়ী সব পদ্ধতীতে এগিয়ে যাবার প্রয়াস চালাবে ৷ ব্যবসায়ী তার ব্যবসাকে আরো সমৃদ্ধ করার, উন্নত করার, প্রতিষ্ঠিত ও লাভজনক করার শুদ্ধ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে ৷
চাকুরে তার আপন পেশায় সর্বোচ্চ উন্নতির প্রয়াস চালিয়ে যাবে ৷ তবে যে চার হাজার টাকা বেতন পায়, সে যদি শুধু পাঁচ ছয় হাজার টাকা বেতনের দিকে তাকিয়ে থাকে, তাহলে কষ্ট পাবে ৷ কিন্তু সে যদি এক দুই হাজার টাকায় চলা মানুষের দিকে লক্ষ্য করে, তাহলে সে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করবে ৷ নিজেকে তার চেয়ে ভাল অবস্থানে আবিষ্কার করবে৷
আরো নানানভাবে এই ইতিবাচক ভাবনা জীবনকে আলো দেয় ৷ যেমন, বাসায় বসা কাজ করতে পারছে না , অসুস্থ আর আমি কাজ করতে পারছি, আমি সুস্থ ৷ তাহলে সে সুস্থতার নেয়ামতের ক্ষেত্রে আমার চেয়ে নিচে ৷ আমার চেয়ে ছোট ৷ অতএব এখানেও আমি লাকি ৷ তেমনই কোন লোকের একটি চোখ আছে; অথচ আমাকে আল্লাহ তায়ালা দুটি চোখ দিয়েছেন, তাহলে চোখের মহান অমূল্য সম্পদের ক্ষেত্রে আমি তার চেয়ে ঢের ভাল আছি ৷ এভাবে মানুষ ভাবলে দেখতে পাবে, হাজার মানুষের চেয়ে ভাল থাকার অনেক উপাদান নিজের মধ্যে বিরাজ করছে ৷ সে নিজের অজান্তেই বলে ফেলবে আলহামদুলিল্লাহ!
আহার ছড়ানো বিশ্বময়
আল্লাহ তায়ালা যাকে যেভাবে ইচ্ছা রিযিক দেন ৷ কাকে টেবিল চেয়ারে বসিয়ে রিযিক দিচ্ছেন ৷ কিছু পৃষ্ঠা উল্টাচ্ছে ৷ কিছু সাইন করছে ৷ দু’চারটা কথা বলছে ৷ মাস শেষে পূর্ণ বেতন পাচ্ছে ৷ কারো রিযিক দিচ্ছেন পথে ৷ গাড়ী ড্রাইভ করছে কিংবা রাস্তা মেরামতের কাজ করছে ৷ অত:পর বেতন পাচ্ছে ৷ কারো রিযিক দিচ্ছেন মাচির নিচে ৷ মাটিতে ফসল ফলাচ্ছে ৷ মাটির তলদেশ থেকে খনিজ সম্পদ বের হচ্ছে ৷ তাদের আহারের ব্যবস্থা হচ্ছে ৷ কারো রিযিক রেখেছেন আকাশে ৷ মহাশূণ্যে ৷ পাইলট ৷ আকাশে বিমান না চালালে বেতন পাবে না ৷ বিমান নিয়ে উড়ছে, ঘুরছে ৷ আহার সংস্থান হচ্ছে ৷ নানান পরিবেশে মহান প্রভুর রিযিক ছড়িয়ে দেয়ার পেছনেও গুরূত্বপূর্ণ হেকমত রয়েছে ৷ তাই যার যার পরিবেশে ধারাবাহিকভাবে শ্রম দিতে হবে ৷ হালাল উপায়ে বরকতপূর্ণ জীবন লাভের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে ৷ কিন্তু জগতের বিচিত্র অভিজ্ঞতা এই চূড়ান্ত কথার স্বাক্ষর বহন করে যে, রিযিক বণ্টিত ৷ তোমার চেষ্টা তোমার ভাগের আহারকেই তোমার কাছে আনবে ৷ এর বেশী কে নয় ৷ শত চেষ্টার পরেও অন্যের রিযিক তার কাছেই রয় ৷
বান্দার চেষ্টা ভাগ্যের হাসি
রিয়াদের এক বিশিষ্ট আলেম ছিলেন ৷ সাদেক মুজাদ্দেদী রহ. ৷ উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তা ৷ তার পিতা অনেক বড় আলেম ও গুণী মানুষ ছিলেন ৷ আফগানিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী কিংবা রাষ্ট্রদূত ছিলেন ৷ একবার তাকে মন্ত্রণালয়ের কাজে রাশিয়ার কোন অঞ্চলে যেতে হয় ৷ এটা একটা শতসিদ্ধ বিষয় ছিল যে, সেখানে ইসলামী পদ্ধতীতে যবাই করা কোন হালাল পশুর গোশ্ত পাওয়া যায় না ৷ তাই তার স্ত্রী তাদের সাথে থাকা দুটি মুরগী জবাই করে রান্না করে নেয় ৷ উদ্দেশ্য ওখানে গিয়ে খাওয়া যাবে ৷ তারপর ওরা তাদের কাঙ্ক্ষিত অঞ্চলে পৌঁছলে সেখানে একজন মুসলিম বন্ধু পেয়ে যায় ৷ সেও তাদের সাথে আসে ৷ একসাথে খানা খাবে ৷ কিন্তু সামনেই দেখে এক হতদরীদ্র নারী তার বাচ্চাদেরকে নিয়ে রাস্তায় বসে আছে ৷ পাককরা মুরগীদুটো তাদেরকে দিয়ে দেয় ৷ মুরগীগুলো তাদের হাতে ছিল ৷ নিজ হাতে পাক করা ছিল ৷ কিন্তু এটি তাদের রিযিক ছিল না! এটির তাকসীম ছিল ওই নারী ও তার সন্তানদের জন্য ৷ তাই সেই পেয়েছে ! দান, মূলত তোমার রিযিক তাকে দিয়ে দিচ্ছ এমন নয় ৷ বরং তার রিযিকই তাকে দিচ্ছ ৷ আল্লাহ তোমাকে শুধু মাধ্যম বানিয়েছেন ৷ তোমার হাতকে বাহন বানিয়েছেন ৷
যেমন মাদরাসায় ২৫ জন শিক্ষক আছে ৷ প্রত্যেকেই এসে অফিস থেকে বেতন সংগ্রহ করেছে ৷ একজন আসেনি ৷ তুমি তাকে পৌঁছে দিয়েছ ৷ তুমি তাকে উপকার করলে ৷ তার রিযিক শুধু তাকে পৌঁছে দিয়েছ ৷ এভাবেই আল্লাহ সবাইকে রিযিক দেন ৷ কাউকে সরাসরী কাউকে কারো মাধ্যমে ৷ তাই এই বিশ্বাস রাখা চাই ৷ আল্লাহ আমার ভাগ্যের অংশ আমাকে দিবেন ৷ পাশাপাশী আমার প্রয়োজনীয় সাধনা-চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে ৷ এটা আমার দায়ীত্ব ৷
আর আমার জরুরী রিযিক আল্লাহ তায়ালা আমার কাছে পৌঁছে দিবেন এটা আল্লাহর দায়ীত্ব ৷ আর প্রাপ্ত রিযিকের উপর তুষ্ট ও তৃপ্ত থাকা এটা আমার ঈমানী দায়ীত্ব ৷