ছাকিবুল ইসলাম কাসেমী
তিন জাতির সহাবস্থানে একটি বর্ণিল সংস্কৃতির দেশ মালয়েশিয়া ৷ ভাষা বর্ণ ও ধর্মের সব ভেদাভেদকে তুচ্ছ করে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বিশ্বের দরবারে ৷
পবিত্র ধর্ম, নিজস্ব কর্ম, শিক্ষার ঐতিহ্য, আদর্শের আভিজাত্য ও উন্নয়নস্বপ্ন নিয়ে বয়ে যায় তাদের সময় ৷ ধর্মের প্রতি অকৃত্তিম আস্থা, কর্মের ক্ষেত্রে ঐকান্তিক নিষ্ঠা, শিক্ষার অঙ্গনে অরূদ্ধ পথচলা, আদর্শের পথে আপোষহীনতা ও উন্নয়নপ্রশ্নে আকণ্ঠ মগ্নতা তাদেরকে আত্বনিবেদনে আরও একনিষ্ঠ করে তুলে ৷
এখানে ধার্মিকতাকে আধুনিকতা ও উন্নত বিশ্বের বৈষয়িক প্রতিযোগিতার অন্তরায় ভাবা হয় না ৷ চলমান জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ও পরিপূরক মনে করা হয় ৷ কারও দু:খ-কষ্টে কেউ এগিয়ে আসতে কার্পণ্য বোধ করে না ৷ কারও সুখানন্দে ও এগিয়ে যাওয়ার নির্মল গল্পে কেউ অন্তর্জ্বালা বোধ করে না ৷ কারও অগ্রযাত্রাকে বাঁধাগ্রস্ত করার জরাগ্রস্ত নষ্টচিন্তাকে মোহাবিষ্ট হয়ে লালন করার অরুচিকর আগ্রহও দেখা যায় না কারও মধ্যে ৷
প্রিয় পাঠকের জ্ঞাতার্থে বলে রাখি, আমার মালয়েশিয়া বিষয়ক জানাশোনা নেট, ওয়েব, উইকি, এফবি, পত্র-পত্রিকা ও মিডিয়া নির্ভর নয় ৷ শিক্ষকতার সুবাদে প্রায় তিন (2014-2017) বৎসর মালয়েশিয়া থেকেছি ৷ প্রায় আঠারবার দেশে আসা যাওয়া করেছি ৷ বিমানের পাইলট থেকে নিয়ে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, প্রফেসর, প্রশাসন, নেতৃস্থানীয় লোক ও বিভিন্ন পেশা ও শ্রেণীর মানুষের সাথে মিশেছি ৷ ছোট্র একটি ব্যবসায়ীক সংশ্লিষ্টতায় অর্থনৈতিক অঙ্গণকেও টাচ করেছি ৷ মালয়েশিয়ার পার্শস্ত দেশ ব্রুনাই, থাইল্যাণ্ড ও সিংগাপুর আসা যাওয়া করেছি ৷ এভাবে বর্ণিল প্রত্যক্ষ্য অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়েছি ৷ তাই মেনুয়াল, থিউরীকেল ও তথ্য-তত্বমূলক আলোচনা না করে জীবনধর্মী প্র্যকটিক্যাল কিছু মৌলিক বিষয় নিয়ে সামান্য কথা বলব ইনশাআল্লাহ ৷ যেসব বিষয় যথারীতি আমাকে আলোড়িত করে ৷ সম্ভাবনাময় আমার দেশ ও দেশের মানুষদেরকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে অনুপ্রাণিত করে ৷
ধর্মচর্চা: –
দেশটির রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ৷ আরও বহু ধর্মের গুঞ্জরন থাকলেও ইসলামের পাশাপাশী বৌদ্ধ ( চায়নীজ) ও হিন্দু (ইণ্ডিয়ান) ধর্মের অবস্থানই সুদৃঢ় ৷ তাই তিনটি ধর্মীয় উৎসবেই সরকারী ছুটি থাকে ৷ রাষ্ট্রীয়ভাষা মালয় হলেও প্রশাসনিক অফিসিয়াল ভাষা হিসেবে চায়নীজ ও তামিলেরও ব্যবহার হয় ৷ চায়না বৌদ্ধ ও তামিল হিন্দুদের ধর্মীয় উৎসব পালনের জন্য নির্দিষ্ট অঞ্চল ভাগ করে দেয়া আছে ৷ সেসব এলাকায় তারা এতটাই স্বাধীন যে, উৎসবকালীন সময়ে সেসব এলাকায় গেলে আপনার মনে হবে এটা চীন বা ভারতের কোনো অঙ্গরাজ্য ৷
এক্ষেত্রে ব্রুনাই একটি আদর্শ রাষ্ট্র ৷ উৎসব ও সাধারন জীবন যাপনের ক্ষেত্রেও পরিবেশ নষ্টকারী অস্বাভাবিক শর্টড্রেস ও গানবাজনা ইত্যাদীর ব্যপারে ওখানে বিধিনিষেধ আরোপ করা আছে ৷
সবচেয়ে মজার ব্যপার হল, মালয়েশিয়ার মুসলিম সমাজটি প্রায় পূর্ণাঙ্গভাবেই মসজিদভিত্তিক ৷ দিন রাত মসজিদের আবহেই আবর্তিত হয় ছোটবড় সব বিষয় ৷ বিয়ে-শাদী মসজিদে ৷ অনুষ্ঠান মসজিদে ৷ সেমিনার সিম্পোজিয়াম মসজিদের নির্দিষ্ট হলে ৷ ছোট বড় নারী পুরূষদের প্রাত্যহিক সাপ্তাহিক পাক্ষিক মাসিক সব দীনি শিক্ষাকার্যক্রম মসজিদে ৷ ওয়াজ মাহফিলের জন্য বিশাল বাজেটে এখানে সেখানে ভিন্ন কোনো সিজোনাল আয়োজন নেই, প্রতিদিন মসজিদে বাদ মাগরিব নির্দিষ্ট বিষয়ের নির্দিষ্ট আলোচকের মাধ্যমে নিয়মিত মাহফিল চলতে থাকে ৷ আগ্রহী নারী পুরুষগণ অংশগ্রহণ করে দীনি ক্ষুধা তৃষ্ণা মিটাতে থাকে ৷
শাফেয়ী মাযহাবের বিধানগত আনুকল্যে এবাদত, শিক্ষা, সাংস্কৃতি বিষয়ক সব আয়োজনেই প্রয়োজনীয় পর্দার ব্যবস্থাপনার সাথে নারীপুরুষ সবাই অংশগ্রহণ করে থাকে ৷ পারিবারিক সামাজিক ও কালচারাল অধিকাংশ প্রোগ্রাম মসজিদকেন্দ্রিক পরিবেশে হওয়াতে স্বাভাবিকভাবেই অশ্লিলতা ও অনৈসলামিক গান-বাজনা মুক্ত থাকে ৷ আলেম, তালেব, ইমাম দায়ী এসব ইসলামী ব্যক্তিবর্গ এদের কাছে এখনও ফেরেশতা তূল্য ৷ এদের অকৃত্বিম সম্মান ও ভালেবাসা দেখলে আপনার মনে এমন কেউ হয়ে এদেশে আজীবন বসবাসের নিশ্চিত সাধ জাগবে !
মালয়েশিয়ার এই মসজিদকেন্দিক পরিবেশ ও ইসলামপ্রিয় সমাজের উপভোগ্য স্বাদ আমার মনে ও মুখে আজও লেগে আছে ৷
শিক্ষা ও সংস্কৃতি:-
জাতীয় ও আন্তধর্মীয় বড় বড় আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশী প্রত্যেক ধর্মের নিজস্ব বিশেষ প্রতিষ্ঠানও রয়েছে দেশটিতে ৷ বিস্ময়করভাবে কখনও কখনও মুসলিম প্রতিষ্ঠানে চায়না ও হিন্দুদেরকে পড়তে দেখা যায় ৷ আবার চায়নীজ প্রতিষ্ঠানেও পড়তে দেখা যায় মুসলিম ও হিন্দুদেরকে ৷ এটা পারষ্পরিক সম্প্রীতি ও আন্তরিকতা থেকেই হয়ে থাকে ৷ শিক্ষা-দীক্ষার ব্যপারে মুসলমানদের পরে কোয়ালিটি ও কোয়ানটিটি উভয় ক্ষেত্রে চায়নারাই এগিয়ে ৷
মুসলিম মালয়েশিয়ার শিক্ষাব্যবস্থা অনেকটা বাংলাদেশের মতোই তিনটি ধারায় চলমান ৷ স্কুল কলেজের সাধারন শিক্ষা, সরকারী মাদরাসা ও বেসরকারী মাদরাসা ৷ সরকারী মাদরাসায় সিলেবাসজনিত সরকারী কোনো বিশেষ বিধিনিষেধ নেই ৷ শুধু কিছু সুপারিশ থাকে ৷ মাদরাসা কতৃপক্ষ নিজেদের মত করে সিলেবাস তৈরী করে নিতে পারে ৷ সরকারী অনুমোদনটা বিশেষভাবে বহির্দেশীয় ছাত্র শিক্ষকের জন্য নিতে হয় ৷ বেসরকারী মাদরাসাগুলো পুরো আমাদের কওমী মাদরাসার মতোই ৷ তবে সরকারী বেসরকারী সব মাদরাসাতেই সাদা জুব্বা পাগরীর নির্দিষ্ট ড্রেস থাকে ৷ এই সফেদ পোশাকের আভিজাত্য পরিবেশকে এক অনন্য সৌন্দর্য দান করে ৷ শাফেয়ী মাযহাব বান্ধব সিলেবাস হলেও ইদানিং দারুল উলুম দেওবন্দ ও পাকিস্তানে তাদের ব্যাপক পড়াশোনার সুবাদে অধিকাংশ দাওরাহাদিস মাদরাসা এখন পুরো দারুল উলুম দেওবন্দের অনুসরনেই পরিচালিত হচ্ছে ৷
সাধারন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় শিক্ষার গুরূত্বের ব্যপারে তারা প্রবাদতুল্য বলা যায় ৷ ধর্মশিক্ষা ধর্মীয় শিক্ষক আমাদের স্কুলগুলোতেও আছে, কিন্তু ব্যবধানটা কত বিশাল দেখুন ৷ যে ব্যবধান ওদের সারা দেশের স্ট্রাকচারকেই পাল্টে দিয়েছে ৷ আমাদেরতো সরকারী প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে ধর্মশিক্ষার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই ৷ অনেক স্কুলে এবিষয়ের কোনো নির্দিষ্ট পুস্তকও নেই ৷ আর যেখানে আছে তাদের অবস্থা হল, স্কুল কলেজ ভার্সিটি শেষ হচ্ছে, তবু না কুরআন শরীফের শুদ্ধ তেলাওয়াৎ জানে, না নামাজ রোজা হজ্ব যাকাতের জরুরী মাসায়েল জানে ৷ ব্যতিক্রম এক দু\’টি ঘটনা পারিবারিক পরিচর্যার কারণে হয়, প্রতিষ্ঠানের কল্যাণে নয় ৷ যা বড়ই আফসুসজনক ও হতাশাব্যঞ্জক ৷
মালয়েশিয়ায় সরকারী বেসরকারী কিংবা মুসলিম ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল হলেও অনুর্ধ্ব প্রাইমারী লেবেলেই বিশুদ্ধ কুরআন তেলাওয়াৎসহ ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের স্পষ্ট ধারনা ও বয়সের স্তর অনুপাতে জরুরী পারিবারিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক জ্ঞান অর্জন বাধ্যতামূলক ৷ তাই অন্যান্য বিষয়ের সাথে বিশুদ্ধ কুরআন তিলাওয়াতে উত্তীর্ণ না হতে পারলে মাধ্যমিক স্তরের জন্য ভর্তির অযোগ্য বলে বিবেচিত হয় ৷
আমিতো এক প্রতিষ্ঠানে কেজি ২য় ৩য় শ্রেণীর ছাত্র-ছাত্রীদেরকে কা\’বা শরীফ, হাতীম, হজরে আসওয়াদ ইত্যাদী বানিয়ে এহরামের কাপড় পড়িয়ে হজ্বের পূর্ণ প্রশিক্ষণ প্রদান উপভোগ করে দারুণ শিহরীত হয়েছিলাম ৷ টুনটুনিদের চমৎকার তেলাওয়াৎ আর আরবি লেখার কথা না হয় নাই বললাম ৷ অথচ দাওরা পর্যন্ত দীর্ঘ মাদরাসার শিক্ষা জীবনে কোথাও এমন কোনো সুন্দর প্রশিক্ষণ দেখিনি ৷
শিক্ষার শেকড়ে এই কুরআনী শিক্ষার বাধ্যবাধকতায় সমগ্র দেশ জুড়ে এক অন্যরকম পবিত্র ও চমকে উঠা চিত্র আপনি দেখতে পাবেন ৷ যা অনেক মুসলিম দেশে এখনও দু:স্বপ্নই বলা চলে ৷ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, প্রফেসর,ব্যবসায়ী, শ্রমিক, ড্রাইভার,পুলিশ, সেনাবাহিনী যে কারো কাছে অন্যান্য পূজী যতটুকোই থাকুক না কেন, বিশুদ্ধ কুরআন তিলাওয়াৎ, বেশ কিছু আরবি দোয়া ও জরুরী মাসায়েলে সে সমৃদ্ধ থাকবেই ৷
একবার এক বাসষ্ট্যাশনের নামাজ ঘরে পেনশার্ট পরা দাড়ীবিহীন এক ড্রাইভার ইমামতি করতে গেলে ভেবেছিলাম \” একলাই নামাজ পড়ে নেই, তার তিলাওয়াৎ শুদ্ধ হয় কী না ?\” পরে জামাতে শরীক হলে তার শুদ্ধ সুমধুর তিলাওয়াতে ও নামাজ শেষে দীর্ঘ আরবি দোয়াসমূহ পড়তে শুনে মনে মনে অনেক লজ্জিত হয়েছিলাম ৷
২০১৫ তে মালয়েশিয়া এয়ারপোর্টে প্রথমবার যখন ইমিগ্রেশন অফিসার আমার ইন্টারভিউ নিচ্ছিল; তার আরবি কথা, শুদ্ধ তিলাওয়াৎ ও শিয়া সুন্নী বিষয়ক বিভিন্ন গুরূত্বপূর্ণ প্রশ্ন শুনেতো আমি ঠিক বুঝতেই পারছিলাম না, আমি কী কোনো পুলিশ অফিসারের সামনে দাঁড়িয়ে আছি না কী কোনো বিশেষজ্ঞ মুফতী সাহেবের সামনে আছি !
এমন ঘটনা অনেক ৷ দেশের সব অঙ্গনের রন্দ্রে ও মর্মে, কর্তাব্যক্তিদের মন ও মননে দীনি শিক্ষার ঘনিষ্ঠতা থাকাতে সব পরিবেশেই এক অপার্থিব পবিত্র আবহ বিরাজ করে ৷ পাপ পুণ্যের এই পৃথিবীতে সকলেই আরেকটু শুদ্ধদিল ও চিন্তাশীল কদম ফেলার চেষ্টা করে ৷