আমীর হামযাহ
ইসলামে বিবাহ ও পারিবারিক জীবন এমন এক অমূল্য সম্পদ, যা শুধু ব্যক্তিগত সম্পর্কের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এক পবিত্র, আধ্যাত্মিক বন্ধন হিসেবে জীবনের গভীরতা ও দিকনির্দেশনা প্রদান করে। এটি একদিকে যেখানে দুটি মানুষের সম্পর্ক গড়ার এক মাধ্যম, অন্যদিকে আল্লাহর সঙ্গে এক অটুট সম্পর্কের অঙ্গীকার। বিবাহের মাধ্যমে আমরা শুধু দুনিয়াতে সুখ ও শান্তি লাভ করি না, বরং আখিরাতে সফলতারও পথ প্রশস্ত করি। ইসলামের দৃষ্টিতে বিবাহ হলো এক গভীর প্রক্রিয়া, যা মানুষকে আল্লাহর পথে পরিচালিত করে এবং একে অপরকে পরিপূর্ণ শান্তি ও শান্তি দেয়। এই প্রবন্ধে আমরা ইসলামের দৃষ্টিতে বিবাহের গুরুত্ব, উদ্দেশ্য, শর্তাবলী এবং পারিবারিক জীবনের শান্তি ও সৌহার্দ্যের দিকগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
১. ইসলামে বিবাহের তাত্পর্য ও গুরুত্ব
ইসলামে বিবাহকে এক পবিত্র চুক্তি হিসেবে দেখা হয়, যা আল্লাহর নির্দেশনা অনুসারে সম্পাদিত হয়। কোরআনের আয়াতে আল্লাহ বলেন:
“আর তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকে সঙ্গী সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের সাথে শান্তি ও সান্ত্বনা পেতে পারো।”
(সুরা রুম, ৩০:২১)
এই আয়াত থেকে স্পষ্টভাবে বুঝা যায়, বিবাহ শুধুমাত্র দুটি ব্যক্তির মধ্যে সম্পর্ক গড়ার জন্য নয়, বরং এটি আল্লাহর সঙ্গে এক গভীর সম্পর্ক স্থাপনের একটি মাধ্যম। বিবাহের মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে সহানুভূতি, ভালোবাসা, শান্তি ও সান্ত্বনা প্রদান করে, যা দুনিয়ার শান্তি অর্জন ছাড়াও আখিরাতে সফলতার মূল চাবিকাঠি হিসেবে কাজ করে।
২. বিবাহের উদ্দেশ্য
ইসলামে বিবাহের রয়েছে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য, যেগুলোর মধ্যে মূল উদ্দেশ্যগুলো হলো:
- ধর্মীয় ও মানসিক শান্তি: বিবাহের মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রী একে অপরের পাশে দাঁড়িয়ে জীবনের সুখ, শান্তি ও স্থিতিশীলতা গড়ে তোলে। একে অপরকে আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের পথে সহায়তা করা, তাদের ইবাদতকে পরিপূর্ণ করার জন্য একে অপরের পাশে থাকা — এটি ইসলামের প্রধান উদ্দেশ্য।
- বংশবৃদ্ধি: ইসলাম সন্তান জন্মের এবং তাদের সঠিকভাবে লালন-পালন করার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে। সঠিক ইসলামী শিক্ষা ও নৈতিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে সন্তানদের পরিপূর্ণ বিকাশের দিকে দৃষ্টি রাখা — এটাই মুসলিম সমাজের মূল উদ্দেশ্য।
- সামাজিক নিরাপত্তা: বিবাহ কেবল পারিবারিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং এটি সমাজের একটি শক্তিশালী ভিত্তি। একটি দৃঢ় ও সহানুভূতিশীল পরিবারই সমাজে স্থিতিশীলতা, নিরাপত্তা এবং শান্তি নিশ্চিত করতে সাহায্য করে।
৩. ইসলামে বিবাহের শর্তাবলী
বিবাহ একটি পবিত্র চুক্তি, যা ইসলামী নীতির ভিত্তিতে নির্দিষ্ট কিছু শর্ত অনুসরণ করে সম্পন্ন হতে হয়। এই শর্তগুলো হলো:
- ইজাব-কবুল: বিবাহের জন্য প্রথমে স্বামী তার প্রস্তাব (ইজাব) দেন, এরপর স্ত্রী সেই প্রস্তাব গ্রহণ করেন (কবুল)। এই দুটি অংশের উপস্থিতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এর মাধ্যমেই বিবাহের বৈধতা নিশ্চিত হয়।
- সাক্ষী: বিবাহের সঠিকতা নিশ্চিত করতে দুইজন পুরুষ অথবা এক পুরুষ ও দুটি মহিলা সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত থাকতে হয়।
- মহর: মহর, বা স্ত্রীর জন্য নির্ধারিত অর্থ, যা স্ত্রীর অধিকার এবং মর্যাদাকে সম্মান জানাতে স্বামী দ্বারা প্রদান করা হয়। এটি স্ত্রীর স্বাধীনতা এবং বিবাহের পবিত্রতাকে আরো শক্তিশালী করে। অবশ্য আলোচনা না করলেও বিবাহ হয়ে যায় এবং মহর আবশ্যক হয়।
৪. বিবাহের প্রক্রিয়া ও সময়
ইসলামে বিবাহের কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম এবং সময়সীমা রয়েছে, যা অনুসরণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
- সাক্ষী ও পুরস্কারের গুরুত্ব: বিবাহের অনুষ্ঠানে দুইজন পুরুষ অথবা এক পুরুষ ও দুইজন মহিলা সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত থাকতে হবে। এরপর, স্বামী/স্ত্রী অপরকে কবুল করে বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন করবেন এবং মহরের পরিমাণও নির্ধারণ করা হবে।
- বিবাহের আয়োজন: বিবাহ সুন্নত হিসেবে মসজিদ আয়োজন করা উত্তম। তবে পারিবারিক পরিবেশে আয়োজন করা যায়। পাশাপাশি প্রকাশ্যে হওয়া সুন্নত, যাতে সমাজে এর কাছে ঘোষণা পৌঁছায়।
৫. তালাকের বিধান
ইসলামে তালাক একটি অত্যন্ত নিকৃষ্ট, তবে হালাল কাজ হিসেবে গণ্য করা হয়। এটি কেবল তখনই গ্রহণযোগ্য, যখন সমস্ত চেষ্টা, সমঝোতা এবং আলোচনা ব্যর্থ হয়ে যায়।
- তালাকের শর্ত: স্বামী তার স্ত্রীকে তিনবার তালাক দিতে পারেন, তবে তা নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে এবং শর্তসাপেক্ষে হতে হবে। তালাকের পর, স্ত্রীর ইদ্দত (একটি নির্দিষ্ট সময়কাল) শেষ হওয়ার পরই তিনি আবার বিয়ে করতে পারবেন। (বিস্তারিত আলোচনার দাবি রাখে।)
৬. পারিবারিক জীবনে তাকওয়া (খোদাভীতি)
ইসলামে দাম্পত্য জীবন ও পারিবারিক শান্তি বজায় রাখার জন্য তাকওয়া বা আল্লাহভীতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যখন স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে আল্লাহর হুকুম পালনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকে, তখন সেই পরিবারে সুখ, শান্তি এবং সুশৃঙ্খল জীবন গড়ে ওঠে। কোরআনে আল্লাহ বলেন:
“পুরুষরা নারীদের তত্ত্বাবধায়ক, এ কারণে যে, আল্লাহ তাদের একের উপর অন্যকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন এবং যেহেতু তারা নিজদের সম্পদ থেকে ব্যয় করে। সুতরাং পুণ্যবতী নারীরা অনুগত, তারা লোকচক্ষুর অন্তরালে হিফাযাতকারিনী ঐ বিষয়ের যা আল্লাহ হিফাযাত করেছেনে। আর তোমরা যাদের অবাধ্যতার আশঙ্কা কর তাদেরকে সদুপদেশ দাও, বিছানায় তাদেরকে ত্যাগ কর এবং তাদেরকে (মৃদু) প্রহার কর। এরপর যদি তারা তোমাদের আনুগত্য করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কোন পথ অনুসন্ধান করো না। নিশ্চয় আল্লাহ সমুন্নত মহান।”
(সুরা আল-নিসা, ৪:৩৪)
৭. বংশবৃদ্ধি ও সন্তান পালন
ইসলামের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হলো সন্তান জন্ম দেওয়া এবং তাদের সঠিক পরিচর্যা করা। পারিবারিক জীবনে সন্তানদের সঠিক শিক্ষা, সৎ আচরণ গঠন এবং তাদের আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের বিকাশের দিকে মা-বাবা উভয়কেই সতর্ক হতে হয়। এটি শুধু দুনিয়ার জন্য নয়, বরং আখিরাতে সওয়াব অর্জনের এক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়।
৮. পারিবারিক সুরক্ষা এবং শান্তি
ইসলামে বিবাহের মাধ্যমে একটি শক্তিশালী ও সহানুভূতিশীল পরিবার গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়। স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে সুরক্ষা, সহানুভূতি, ভালোবাসা প্রদান করে, যা পারিবারিক শান্তি বজায় রাখতে এবং সমাজে স্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে সহায়ক।
ইসলামে বিবাহ এক পবিত্র চুক্তি, যা দাম্পত্য জীবন, পারিবারিক শান্তি এবং সামাজিক উন্নতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা। এটি একে অপরকে আল্লাহর পথে পরিচালিত করতে সাহায্য করে এবং মানুষের জীবনকে শান্তিপূর্ণ ও আধ্যাত্মিকভাবে সমৃদ্ধ করে তোলে। ইসলাম শুধু বিবাহের আইনগত দিকগুলো নয়, বরং এটি এক আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়া, যা ব্যক্তিগত সম্পর্ক থেকে সমাজের বৃহত্তর কল্যাণে পৌঁছাতে সাহায্য করে। তাই, ইসলামে বিবাহ একটি সঙ্গীসত্তার অমূল্য উপহার, যা জীবনকে আল্লাহর হুকুমে পরিচালিত করতে সহায়তা করে এবং একটি সুন্দর, শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ সমাজ গড়ে তোলে।