মূল: শায়খ আলী তানতাবী
ভাষান্তর: ছাকিবুল ইসলাম কাসেমী
আল্লাহ একজন মানুষ রাসূল পাঠিয়েছেন ৷ তিনি আমাদেরকে জানিয়েছেন; যেই পৃথিবীতে তোমরা বসবাস করছো, জীবন যাপন করছো, একদিন এই পৃথিবী বদলে যাবে ৷ তার আয়ু ফুরিয়ে যাবে ৷ সে নিজের অস্তিত্ব হারাবে ৷ পৃথিবীতে অবস্থানকারী সবাই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে ৷ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা পাহারগুলোও ভেঙ্গে পড়বে ৷ উড়ে যাবে ৷
ويسألونك عن الجبال فقل ينسفها ربي نسفا
“তারা আপনাকে পাহাড় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে, আপনি বলে দিন আমার পালনকর্তা পাহাড়সমূহকে সমূলে উৎপাটন করে বিক্ষিপ্ত করে দিবেন ৷” (সূরা ত্বহা; ১০৬)
আজকে পৃথিবীবাসী এই গগণচুম্বী পাহাড়ে আরোহণের চেষ্টা করে ৷ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হাজার মিটার উচ্চতার হিমালয় কে জয় করার স্বপ্ন দেখে ৷ কালকে এই উঁচু শির পাহাড় নিজেই পরাজিত হবে ৷ সমতল পৃথিবীর অন্দরে আপন পরিচয় বিলীন করবে ৷
فيذرها قاعا صفصفا لا تري فيها عوجا ولا أمتا
অত:পর পৃথিবীকে মসৃণ সমতল ভূমি করে ছাড়বেন ৷ তাতে তুমি কোন মোড় বা টিলা দেখতে পাবে না (সূরা ত্বহা/১০৮-১০৯)
تبدل الأرض غير الأرض والسماوات وبرزوا لله الواحد القهار
এই পৃথিবীকে অন্য পৃথিবীতে পরিবর্তন করা হবে ৷ আকাশসমূহকে পরিবর্তন করা হবে ৷ লোকেরা পরাক্রমশালী এক আল্লাহর সামনে পেশ হবে ৷ (ইবরাহিম /৪৮)
গন্তব্যের দিগন্ত কোথায়?
আমরা তাহলে কোথায় যাব ? কোথায় থাকব? এখানে কী কোন বাড়ীঘর থাকবে? কোন আসবাবপত্র থাকবে? না বরং নতুন এক জগতের যাত্রা শুরু হবে? নতুন আবাসনের ব্যবস্থা হবে ৷ যেখানে আর কোন ধ্বংস স্পর্শ করবে না ৷ যে জীবনের দিন রাত আর থেমে যাবে না ৷ সুখের ফাগুনে আর আগুন লাগবে না ৷ এই হলো দুনিয়া ও আখেরাত ৷
কিছু মানুষ আছে যারা হৃদয় দিয়ে এই চির সত্যকে ধারণ করে লালন করে ৷ সর্বান্তকরণে এই বিশ্বাস রাখে ৷ এই পৃথিবীর সব আয়োজন একদিন হারিয়ে যায় ৷ জীবন যত দীর্ঘই হোক একদিন নি:শ্বেষ হয়ে যায় ৷ বিদায় ঘণ্টা বেজে যায় ৷ এই সিমান্তপ্রাচীর ব্যক্তির জন্যও যেমন দাঁড়িয়ে যায়, দাঁড়িয়ে যায় ধীরে ধীরে সবার জন্য ৷ হারিয়ে যায় সবাই অনন্ত সত্যের আড়ালে ৷
অনন্তের অভিযাত্রী সবাই
এই আমি আট দশকের জীবনকে সুদীর্ঘ মনে করি ৷ আরও বাঁচার স্বপ্নও দেখি ৷ তারপর আমার যাত্রাও মহাসত্যের অরূদ্ধ মিছিলেই হবে–তাও মনে প্রাণে বিশ্বাস করি ৷
সিরিয়ার বিশিষ্ট শায়েখ, সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলেম, শায়েখ আব্দুল মুসিল উসতুয়ানী ৷ ইলমী পরিমণ্ডলে ব্যাপক জনপ্রিয় একজন ব্যক্তিত্ব ৷ তাঁর মুখনি:সৃত প্রতিটি কথা সিরিয়ার জনপদে দারুণ আপ্যায়িত ৷ মহাসমারোহে সুদীর্ঘ কর্মময় জীবন কাটিয়েছেন ৷ ১১৮ বৎসর বেঁচেছেন ৷ তারপর মাওলার ডাকে সাড়া দিয়েছেন ৷ পৃথিবীর সফরটা দীর্ঘ ছিল, কিন্তু যথারীতি সিমান্ত প্রাচীরে বাঁধা ছিলেন ৷
হযরত নূহ আ. পৃথিবীতে এসেছেন ৷ কত দীর্ঘ সময় পেয়েছেন! পৃথিবীতে বিচরণ করেছেন ৷ এক আল্লাহর দিকে মানুষকে দাওয়াত দিয়েছেন ৷ মহান দায়ীত্ব পালন করেছেন ৷ পৃথিবীকে ঈমানী আলোয় আলোকিত করতে চেয়েছেন ৷ ৯৫০ বৎসর নিরবচ্ছিন্নভাবে দিন রাত কাজ করেছেন ৷ তারপর ? মহান প্রভুর ডাকে সাড়া দিয়েছেন ৷ দীর্ঘ দাওয়াতী সফরকে সমাপ্ত করেছেন ৷
হৃদয়হীনার উপমা
এটাই পৃথিবীর মূল পরিচয় ৷ এটি চলে যাবার বিশ্রামাগার, থাকার ঠিকানা নয় ৷
এভাবেই বহমান পৃথিবীর বহমান সব সুখ-দু:খের অনুরণন ৷ কান্নার অশ্রুধারা ও হাসিভরা বিনোদন ৷
ব্যথা ও ভালোবাসার সব আয়োজন সময়ের শিকলে আবদ্ধ ৷ পৃথিবীর উপমা কেউ এভাবেও পেশ করেন; নাটক, ফিল্ম, সিনেমায় দেখ; বাড়ী-ঘর, গাছপালা, ফুলপাখি, মাঠঘাট, নদীসাগর, দোকানপাট, আকাশজমিন সবই আছে ৷ পূর্ণাঙ্গ শহরের, সমৃদ্ধ দেশের, পরিকল্পিত জীবন আয়োজনের সবকিছুই থাকে, তবে সবই নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ৷ সীমাবদ্ধ প্রহরের জন্য ৷ ঠিক তেমনই পৃথিবী, চার দেয়ালের অভ্যন্তরে গড়ে উঠা এক গল্প ৷ এর মধ্যে যা কিছু আছে,সবকিছুর বয়সই এমন অল্প! পুরো দুনিয়ার মর্মই হলো, ‘এখানের সব সৃষ্টি–ধ্বংসের জন্য’!
দুনিয়াতে কে চিরকাল থাকবে? দুনিয়া কার জন্য স্থায়ী হবে? কেউ দুনিয়াতে থাকবে না ৷ দুনিয়াও কারো জন্য রইবে না৷ একবার এক ফকির রাজার দরবারে গিয়ে নসিহত করছিল, বাদশাহ নামদার! আপনারা কেউ রাজত্ব হারাতে চান না পৃথিবী ছাড়তে চান না ৷ অথচ, যদি এই আকাঙ্ক্ষা পূরণ করত দুনিয়া, তাহলে আজকে আপনিও রাজত্বের অধিকারী হতেন না! আমাদের কাছে আগের কোন নেয়ামতই পৌঁছত না! তাই এই মৃত্যুর ধারা প্রত্যেক পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আশীর্বাদ ও রহমত হয়ে থাকে ৷ যেমনটি আমাদের জন্য হয়েছিল ৷
তাই এই নশ্বর পৃথিবীতে মানুষ ও প্রাণীদের আসা যাওয়ার ধারাবাহিকতা চলতে থাকবে ৷ মহান প্রভু নতুন প্রজন্ম দিয়ে পৃথিবীকে নতুন রূপে সাজাতে থাকবেন ৷ হাজারও আয়োজনের ভিড়ে, নানান সৌন্দর্য ও সমৃদ্ধির পথে চলমান এই পৃথিবীকেও তার শেষ দিনে নিয়ে দাঁড় করাবেন ৷
চিরন্তণ সত্বায় সমর্পণ
খুব শীঘ্রই এমন একটি দিন আসছে, যেদিন পৃথিবীতে আর কেউ থাকবে না ৷ কোন প্রাণীতে আর প্রাণ সঞ্চারিত হবে না! সবাই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে ৷ সবাই চিরসত্যের স্বাদ গ্রহণ করবে ৷ অনন্ত জীবনের পথে পা বাড়াবে ৷ আমাদের ও পৃথিবীর মহান স্রষ্টা আল্লাহ আমাদেরকে জানিয়েছেন, একমাত্র তাঁর স্বত্বাই চিরঞ্জীব ৷ অনন্তকাল বেঁচে থাকবে ৷ অন্য সবাই হারিয়ে যাবে ৷ ধ্বংস হয়ে যাবে ৷
كل شيء هالك إلا وجهه
মহান আল্লাহর অস্তিত্ব ছাড়া সবাই ধ্বংসশীল ৷ ( কসস/৮৮)
কিন্তু এই মৃত্যু শুধু ধ্বংসের পদধ্বণি নয়, বরং নতুন জন্মের প্রস্তুতি ৷ অনি:শ্বেষ জীবনের হাতছানি ৷ পেছনের সব ভালোমন্দ বুঝে পাবার অমোঘবাণী ৷
ইবনে আব্দুল ওয়ালিদ নামক এক ঐতিহাসিক নেতা ছিলেন ৷ সে একবার স্বপ্ন দেখে, রাজা বাদশা, আমীর ওমারাদের আসর বসেছে ৷ জন্ম মৃত্যু নিয়ে আলোচনা হচ্ছে ৷ কেউ আশা কেউ ভয় ও সংশয় প্রকাশ করছে ৷ একজন দাঁড়িয়ে বলছে,
ولو أنا إذا متنا نغثنا لكان الموت راحة كل حي
ولكن إذا متنا بعثنا ونسئل بعد عن كل شيء
মৃত্যু যদি হতো মুক্তি বারিশ তাহলে ছিল স্বস্থি সবার
মৃত্যু মূলত আদালতে নেয় পূণর্জীবন ঘটিয়ে আবার ৷
তাই এটা নতুন জন্মের সূচণা ৷ পৃথিবীর জীবনের হিসাব কষার পরিকল্পিত জলসা ৷ আরাধনা বন্দনা নিরন্তর সাধনার সব ফলাফল পাবার ঘোষিত মহা দিবস ৷ এটা কাজের জগত ৷ ওটা প্রাপ্তির ভূবন ৷ ভোগ ও বিনোদনের মুক্ত বাতায়ণ ৷ কিংবা দু:খ ও পরাজয়ের ভাগ্যবরণ ৷
আরেক কবি সুন্দর বলেছেন,
ما مضي فات والمؤمل غيب
ولك الساعة أنت فيها
হারিয়েই যায় অতীত প্রহর স্বপ্নগুলোও পালায়
বেঁচে আছো তুমি যেই সময়ে এটা যেন না হারায়!
অর্থাৎ কর্মহীন অতীত নিয়ে আফসুসের কোন অর্থ নেই ৷ চলে যাওয়া প্রহরে ভাল কিছু করে থাকলে তা তোমার জন্য অপেক্ষা করছে ৷ তুমি ভুলে গেলেও তা তোমার নামে চলে আসবে ৷ আর কিছু না করলে কিংবা মন্দ করে থাকলে তার দু:খজনক পরিণতিও তোমাকে খুঁজে নিবে ৷
জেগে থাকে চোখ পর্যবেক্ষণে
আল্লাহ সব রেকর্ড করে রাখছেন ৷ যান্ত্রিক রেকর্ডের চেয়েও অনেক শক্তিশালী রেকর্ড ৷ অনেক স্পর্শকাতর সংরক্ষণ ৷ সর্বাধুনিক রেকর্ডার শুধু কথিত ও উপস্থাপিত বিষয়কে ধরে রাখতে পারে ৷ কিন্তু মহান প্রভুর সুউচ্চ ব্যবস্থাপনা অনুভুতি চিন্তা পরিকল্পনা ও ভাবনাকেও রেকর্ড করে রাখতে পারে ৷ যা এখনও বলা হয় নি করা হয় নি ৷ সুবিন্যস্তভাবে এই অশরীরী অবয়বকেও হেফাজত করেন মহান প্রভু ৷ তবে মাথার ভাবনা মনের অনুভূতিগুলোর জন্য আল্লাহ পাকড়াও করবেন না ! বিচারের মুখোমুখী করবেন না ৷ তিনি সব জানেন ৷ তিনি প্রতিটি চিন্তার পদক্ষেপেও দৃষ্টি রাখেন ৷ তাও নথিভুক্ত করেন ৷ সুন্দর প্রতিটি পরিকল্পনা ও অনুভূতির জন্যও বান্দা প্রতিদানপ্রাপ্ত হয় ৷ তার এই সুরভিত চিন্তার আলো অনাগত সময় কে প্রদীপ্ত করে তোলে ৷ প্রাণবন্ত করে তোলে ৷ শুদ্ধতার রঙ্গে রঙ্গিন করে দেয় ৷ এসবই করুণাময় প্রভুর করুণা ৷ অশেষ দয়া ও বদান্যতা ৷ পাপ চিন্তাকে ঘটে যাওয়া প্রহর নাগাদ ছাড় দেওয়া ৷ পূণ্য চিন্তাকে জন্মলগ্ন থেকেই পুরস্কারে ধন্য করা ৷ তাই এমন ইতিবাচক পরিবেশকে কল্যাণকর জীবন অর্জনে কাজে লাগানোও জরুরী ৷ জবাবদিহীতার চিন্তার ক্ষেত্রেও উদাসিনতা অনাকাঙ্ক্ষিত ৷