শাইখুল হাদীস, ছাকিবুল ইসলাম কাসেমী
প্রতিনিধিত্বপূর্ণ সমাজব্যবস্থা একটি সভ্যসমাজের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য। আর তাই আল্লাহ রাব্বুল আলামিন প্রতিনিধিত্বপূর্ণ সমাজ দিয়েই পৃথিবীতে মানবসভ্যতার সূচনা করেছিলেন।
মানবজাতির আদি পিতা হজরত আদম (আ.) ছিলেন মানবজাতির প্রথম প্রতিনিধি এবং তিনি ছিলেন প্রথম নবী। যুগে যুগে মহান আল্লাহ সমকালীন মানবগোষ্ঠীর সর্বোত্তম চারিত্রিক গুণাবলির অধিকারী ব্যক্তিকে ওই সমাজের প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব দিয়ে নবী ও রাসুল হিসেবে পাঠিয়েছেন। জনপ্রতিনিধি একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর সার্বিক কর্মকাণ্ডের দায়িত্ব বহন করেন। অর্থাৎ জনপ্রতিনিধির যোগ্যতা, প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার ওপর নির্ভর করে কোনো সমাজ ও জাতির ভবিষ্যৎ নির্মিত হয়। সুতরাং জনপ্রতিনিধির বৈশিষ্ট্যগুণে যেমন একটি সমাজ ইতিহাসের স্বর্ণচূড়ায় আরোহণ করতে পারে, তেমনি তার ব্যর্থতা একটি জাতিকে ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করতে পারে। সে জন্যই জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের গুরুত্ব সীমাহীন। জনপ্রতিনিধিত্বের সবচেয়ে বড় প্ল্যাটফর্ম হলো জাতীয় সংসদ। সুতরাং সংসদ নির্বাচনই যে বাঙালি জাতির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। মানবসভ্যতার সূচনাকাল থেকে একটি নির্দিষ্ট সময়কাল পর্যন্ত মহাজগতের মহিমাময় প্রভু মহান আল্লাহ সমকালের সর্বোত্তম মানুষদের জনপ্রতিনিধি হিসেবে নবী ও রাসুল করে পাঠিয়েছেন।
তাই একদল সমাজবিজ্ঞানীর ধারণা, সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী নেতৃত্বের গুণাবলি নিয়েই জন্মগ্রহণ করে। তাঁদের বক্তব্য Leaders are born, not made’; কিন্তু আল্লাহ রাব্বুল আলামিন হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর মাধ্যমে নবুয়ত ও রিসালাতের ধারা বন্ধ করে দিয়ে সমাজে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর ওপর তাদের প্রতিনিধিত্বকারী নির্বাচনের দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। হয়তো সে কারণেই সমাজবিজ্ঞানীদের বক্তব্যও পাল্টে গেছে। এখন তারা বলছেন, ‘Leaders are made, not born. Leadership is an ability’ একটি অগ্রসরমাণ জাতির প্রতিনিধির মধ্যে কী কী গুণ থাকা উচিত, ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যস্থা হিসেবে সেটি নির্দিষ্ট করে দিয়েছে।
তাকওয়া বা খোদাভীতি : একজন জনপ্রতিনিধির মধ্যে সর্বপ্রথম যে গুণটি থাকা আবশ্যক তা হলো, তাকওয়া বা খোদাভীতি। তাকওয়া মুমিনের জীবনে এমন একটি গুণ, যা তাকে সর্বদা নিজ কর্তব্য পালনে তৎপর রাখে, সঙ্গে সঙ্গে বৈধতার সীমায় তাকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। কারণ মুত্তাকি ব্যক্তি তার জীবনের ছোট-বড় কোনো কাজেই পরকালীন জবাবদিহিতার কথা বিস্মৃত হতে পারে না। তাই মুত্তাকি ব্যক্তিই সামাজিক নেতৃত্বের তথা জনপ্রতিনিত্বের সম্মানজনক আসনে সবচেয়ে উপযুক্ত। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেছেন, ‘হে মানবমণ্ডলী! আমি তোমাদের একজন মাত্র পুরুষ ও একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। অতঃপর তোমাদের বিভিন্ন দল ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পর পরিচিতি অর্জন করতে পারো। নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সবচেয়ে সম্মানিত সে, যে সবার চেয়ে বেশি মুত্তাকি। ’ (সুরা আল-হুজুরাত : ১৩)
আমানতদারি : জনপ্রতিনিধির মাধম্যে তার নির্বাচনী এলাকার ও সেখানে বসবাসকারী জনগণের কল্যাণে প্রয়োনীয় সরকারি-বেসরকারি সহায়তা ও অনুদান এসে থাকে। সুতরাং জনপ্রতিনিধি যদি আমানতদার না হয়, তাহলে জনগণ বঞ্চিত হবে, এলাকার উন্নয়ন কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে হবে না। তাই জনপ্রতিনিধির মধ্যে আমানতদারি থাকা আবশ্যক। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের আদেশ করছেন যে তোমরা আমানতকে তার উপযুক্ত প্রাপকের কাছে পৌঁছিয়ে দেবে। আর মানুষের মাঝে যখন কোনো বিষয়ে বিচার-ফয়সালা করবে, তখন অবশ্যই ইনসাফের ভিত্তিতে তা করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের উপদেশ দিচ্ছেন। আল্লাহ সব কিছু শোনেন ও দেখেন। (সূরা আন্-নিসা : ৫৮)
উন্নত চরিত্র : চরিত্রই মানবজীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ। উসামা ইবনে শারিক (রা.) একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, একবার রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞেস করা হলো, হে আল্লাহর রাসুল! মানুষকে আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামতগুলোর মধ্যে সর্বোত্তম কোনটি? রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, উত্তম চরিত্র। (মুসনাদে আবু দাউদ, হাদিস : ১৩২৯) তাই জনপ্রতিনিধিকে অবশ্যই উন্নত চারিত্রিক গুণাবলির অধিকারী হতে হবে। কারণ চরিত্রহীনকে সমাজের মানুষও ঘৃণা করে এবং আল্লাহ রাব্বুল আলামিনও তাকে পছন্দ করেন না। মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাকে ইয়েমেনের গভর্নর হিসেবে পাঠানোর সময় অসিয়ত করতে করতে শেষ অসিয়ত হিসেবে বলেন, ‘তুমি অবশ্যই তোমার চরিত্রকে সুন্দর করবে। কারণ মানুষের মধ্যে যার চরিত্র বেশি সুন্দর, সে দ্বিনদারির দিক থেকেও তাদের মধ্যে উত্তম। ’ (মুসনাদে আহমাদ : ২১৯৮৯)
জনদরদি : জনপ্রতিনিধির জনদরদি হওয়া অত্যন্ত জরুরি। কারণ যে জনপ্রতিনিধিত্ব করবে, তার মধ্যে যদি জনতার প্রতি ভালোবাসা না থাকে, জনগণের সঙ্গে যদি তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক না থাকে, তাহলে তার দ্বারা জনগণের স্বার্থ রক্ষা সম্ভব নয়। একমাত্র ভালোবাসর মাধ্যমেই জনপ্রতিনিধির পক্ষে এলাকার জনগণ ও মহান আল্লাহর প্রিয় ও আস্থাভাজন হয়ে ওঠা সম্ভব। আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, অনুগ্রহ ও দয়াবানদের ওপর দয়াময় আল্লাহ দয়া ও অনুগ্রহ বর্ষণ করেন। সুতরাং জমিনের অধিবাসীদের ওপর তোমরা দয়া করো, তাহলে আসমানওয়ালা—অর্থাৎ আল্লাহ তোমাদের ওপর দয়া করবেন। (বুখারি ও মুসলিম)
জনসেবা : জনপ্রতিনিধির মধ্যে অবশ্যই জনসেবার মানসিকতা থাকতে হবে। জনগণের সেবা করতে না পারলে তাদের নেতা হওয়া যায় না। আরবিতে একটি প্রবাদ আছে, ‘আমিরুল কওমি খাদিমুহুম’—অর্থাৎ জাতির নেতা তিনি, যিনি তাদের সেবক। আর ইংরেজিতে The greatest servent is the greatest leader. রাসুলুল্লাহ (সা.) শেষ নবী ও শ্রেষ্ঠ নবী হয়েও উম্মতের সেবা করে গেছেন জীবনের শেষ অবধি। সাহাবায়ে কেরাম (রা.) রাসুলে করিম (সা.) থেকে একই শিক্ষা ধারণ করেছিলেন। আমিরুল মুমিনিন ওমর ফারুক (রা.) তাঁর খিলাফতকালে একবার জানতে পারলেন, কুফার গভর্নর সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা.) নিজের জন্য একটা জৌলুসপূর্ণ বাড়ি নির্মাণ করেছেন। যার মধ্যে গভর্নরের জন্য খাস কামরার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। গভর্নরের এহেন আয়েশি জীবনাচারের ফলে জনসাধারণ তাঁর সঙ্গে প্রয়োজনীয় সময়ে সাক্ষাৎ করতে পারে না এবং তারা তাদের প্রয়োজনীয় সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সংবাদ পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে ওমর (রা.) তাঁর বিশেষ দূত, মুহাম্মদ ইবনে মাসালামাকে সেখানে প্রেরণ করলেন। ওমর (রা.)-এর নির্দেশে তাঁর দূত গভর্নরের আলিশান বাড়ি তারই সামনে জ্বালিয়ে ভস্ম করে দিলেন।
আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খোদাভীরু, জনদরদি, উত্তম চরিত্রের অধিকারী যোগ্যতর ব্যক্তিরা নির্বাচিত হয়ে একটি আদর্শ সংসদ গঠিত হবে—সেটাই আমাদের প্রত্যাশা।
জণগন এসব গুণাবলীসম্পন্ন যোগ্য নেতৃত্ব বাছাই করবে, দেশ ও জাতির কল্যাণচিন্তাকে সর্বোচ্চ গুরূত্ব দিবে—এটাই আমাদের বিশ্বাস ৷