ছাকিবুল ইসলাম কাসেমী
জন্মগত অস্তিত্ব, দৈহিক অবকাঠামো, চিন্তার স্বাধীন আভিজাত্য, কর্মের বিস্তীর্ণ ভূমিসত্ব, হাসি কান্নার আবর্তনশীল জীবনতন্ত্র, পরিণতির অভিন্ন নীতিশাস্ত্র- এসব মৌল উপকরণ ও যৌথ আয়োজনের সুপরকল্পিত স্বার্থক সৃষ্টির নামই নারী-পুরূষ ৷ মানুষ ৷ পরাক্রমশালী,প্রজ্ঞাময়, ভূবনের প্রতিটি অনু-পরমানুর আদিঅন্ত জান্তা সুনিপূণ মহান স্রষ্টা হলেন আল্লাহ! তাই জীবনকেন্দ্রিক ও বিধানঘনিষ্ঠ কোন বিষয়ই বিশেষ কোন শ্রেণীর সাথে সম্পৃক্ত হতে পারে না ৷ তাদের একক অর্জন ও সৌভাগ্যের উপলক্ষ্য হতে পারে না! চাই এটা দৈহিক জৈবিক বা বাহ্যকার্য সংশ্লিষ্ট কোন বিষয়ই হোক কিংবা আত্বিক, চিন্তানৈতিক ও শাস্ত্রীক প্রসঙ্গই হোক না কেন!
শরীরী ও অশরীরী কর্মের সর্বোত্তম উপস্থাপন, বিনম্রচিত্তে মহান প্রভুর সন্তুষ্টির জন্য এসব আমলের একনিষ্ট নিবেদনের মাধ্যমে নারী পুরুষ সকলেই ঈর্ষান্বীত সাফল্যের উৎকর্ষ সাধন করুক, এটাই প্রভু চান ৷ আর এটিও একটি শতসিদ্ধ বিষয় যে, ছোট বড় সব সফলতার প্রধান ভিত্তি হলো শিক্ষা ৷ অতপর কাজের দক্ষতা ও আন্তরিকতার আলোকে নিজ নিজ অবস্থানকে প্রত্যেকেই সুসংহত করে নেয়!
তাই নারী পুরুষ সকলের জন্য সমান গুরুত্বের সাথেই শিক্ষার বিষয়ে কথা বলেছেন আল্লাহ ৷ আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহী ওয়াসাল্লাম ৷ কুরআনের সর্বপ্রথম প্রত্যাদেশ, “পড়ুন আপনার সৃষ্টিকর্তা প্রভুর নামে” ৷
আরো বলেছেন আল্লাহ, শিক্ষিত ও মূর্খ মানুষ কী সমান হতে পারে (যুমার:০৯ )৷ অন্ধ ও চক্ষুষ্মান সমান নয় ৷ আলো ও অন্ধকার এক নয় ৷ রোদ ও ছায়া সমান নয় ৷ এক নয় জীবিত ও মৃত ! (ফাতির:১৯-২২)
অন্যত্র বলেন মহান প্রভু, তোমাদের মধ্যে যারা মুমিন ও শিক্ষিত তাদের মর্যাদা কে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছেন আল্লাহ ( মুজাদালাহ:১১) ৷
মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা.ও নারী পুরুষ সকলের জন্য বিদ্যা অর্জন করাকে ফরজ ও অত্যাবশ্যক হিসেবে অভিহিত করেছেন ৷ ” প্রতিটি মুসলিম নর নারীর জন্য শিক্ষা অর্জন করা ফরয-অবশ্যকর্তব্য ৷ শিক্ষীর ব্যাপারে এত স্পষ্ট উচ্চারণ অন্য কোন ধর্মে পাওয়া দুস্কর ৷ বিশেষ করে নারী কে শিক্ষার ক্ষেত্রে পুরুষের সমান দায়ীত্ব ও মর্যাদার স্থানে রাখাটাই ইসলামের দূরদর্শী ও অনন্য শিক্ষাবান্ধব ধর্মের জ্বলন্ত প্রমাণ! হুজুর সা. বরাবরই অজ্ঞতা ও মূর্খতার প্রতি নিরুৎসাহিত করতেন ৷ তিনি বলেন: অজ্ঞতা-মূর্খতা অপেক্ষা বড় দারিদ্র্য আর কিছু নেই ৷ জ্ঞানীর নিদ্রা মূর্খের এবাদত অপেক্ষা উত্তম (–) ৷
শিক্ষানুরাগী মহিলা সাহাবীগণ
এসব সঞ্জীবনী সুধা সেসময় নারী শিক্ষায় এক বিপ্লব সৃষ্টি করেছিল৷ অনেক ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়েও এগিয়ে যেতেন নারীরা ৷ নতুন নতুন সব সমস্যার সমাধানের জন্য শীর্ষ পুরুষ সাহাবাগণও স্মরণাপন্ন হতেন নারী সাহাবীর ! উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা র. ছিলেন এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ ৷
অন্যান্য নারী সাহাবীদের উৎসাহও প্রবাদতূল্য ৷ তারা এসে শিক্ষার অধিকার ও তৃষ্ণা নিবারণে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে বায়না ধরতেন ৷ পৃথক সময় প্রার্থনা করতেন ৷ বোখারী শরীফের একটি বর্ণনায় এসেছে,
শিক্ষানুরাগী মহিলা সাহাবীগণ একবার বললেন, হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আপনি জ্ঞান শিক্ষা দেয়ার জন্য সবসময় পুরুষদের দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকেন। তাই আমাদের জন্য একদিন নির্দিষ্ট করুন। মহানবি [সা.] সে অনুযায়ী তাঁদের জন্য একটি পৃথক দিনের ঘোষণা করেছিলেন ৷ এবং তাদের স্বতন্ত্র প্রয়োজন পূরণে পরিকল্পিত শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা করেছিলেন। এমনকি তিনি প্রতিনিধি পাঠিয়েও নারীদের শিক্ষা দিতেন। ফলে অনেক মহিলা জ্ঞানীর উদয় হয়েছিল, যারা ইসলামের মহান শিক্ষা প্রচারে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
ইসলামী দর্শন নারী শিক্ষার উৎসাহদাতা ও পথপ্রদর্শক। ইসলামে নারী শিক্ষার সুযোগ সীমিত এমন ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। মুসলিম সমাজেও মহিলা শিক্ষক, অধ্যাপক, আইনজীবী, শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক, বিজ্ঞানী, দার্শনিক ও প্রযুক্তিবিদের প্রয়োজনীয়তা আবাহমান কাল থেকেই স্বীকৃত এবং কাঙ্ক্ষিত । তাই ইসলামী ইতিহাসের সব অংশেই শিক্ষীনুরাগী, জ্ঞানসাধক ও সমকালিন বর্ণিল বিষয়ের শাস্ত্রজ্ঞ আলোকিত মুসলিম নারীদের একটি বিশাল দলের সন্ধান পাওয়া যায় ৷ যারা সমকালিন নারীঅঙ্গণসহ জীবনের সব অধ্যায়কে সাজিয়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন ৷
ইসলাম ও নারীশিক্ষা
ইসলাম একটি জীবন্ত সুস্থ পরিচ্ছন্ন ও কল্যাণকর জীবন বিধানের নাম ৷ তাই সবক্ষেত্রেই সব আশঙ্কাজনক পথ থেকে নারী পুরুষকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছে ৷ তুলনামূলক নিরাপদ পথপরিক্রমায় উদ্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করেছে ৷ তাই পরিণত বয়সে তরুণ তরুণীদের মধ্যে পর্দার বিধানকে ফরজ করে দিয়েছে ৷ অবাধ অশ্লীলতা ও যৌনতায় মত্ত হয়ে হাজারো লাখো সম্ভাবনাময় সন্তান যেন ধ্বংসের অতল গহ্বরে হারিয়ে না যায় সে চেষ্টা করা হয়েছে ৷ এতে মা-বাবার স্বপ্নও নষ্ট হচ্ছে ৷ পাপের নিশ্চিত অংশীদার হওয়ার পথও উন্মুক্ত হচ্ছে ৷ তাদের কষ্টও পণ্ডশ্রমে পরিণত হচ্ছে ৷ সন্তানগুলো নিজেরাও আলোকিত সফল গন্তব্যের পথ থেকে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় দূরে সরে যাচ্ছে ৷
অতএব, নারীদের ব্যাপারে উচ্চশিক্ষায় কোন আপত্তি নেই বরং ইসলাম নারীদেরকে পর্দার মহান ও কল্যাণকর বিধান মেনে শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রগামী হওয়ার প্রতি উৎসাহ ও নির্দেশনা দিচ্ছে ৷
ইসলাম নির্দেশিত নিরাপদ ফর্মূলা
তাই আমরা অনুসন্ধানী দৃষ্টি ফেরালে দেখি, শুধু আলেম শ্রেণী নয়; বরং সাধারণ শিক্ষিত, সচেতণ, দূরদর্শী মুসলিম অভিভাবকগণ এমনকি অমুসলিমগণও তাদের কণ্যা সন্তানদের ব্যাপারে ইসলাম নির্দেশিত এই নিরাপদ ফর্মূলাকেই গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করেছেন ৷ তারা সহশিক্ষাকে এড়িয়ে চলেছেন ৷ কণ্যা সন্তানকে বালিকা বিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন ৷ ছেলে সন্তানকে বালক বিদ্যালয়ে দিয়েছেন ৷ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পড়াশোনা ঢাকার একটি বালিকা স্কুলেই চালিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ৷ সমকালিন এমন গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ব্যাক্তিদের অধিকাংশই নিজ সন্তানদের ব্যাপারে এই নিরাপদ পথকেই গ্রহণ করেছেন ৷ অথচ সেই পরিবেশ আকাশ সংস্কৃতিতে আক্রান্ত চলমান এই নষ্ট সময়ের চেয়ে কত শঙ্কামুক্ত ছিল! তবুও তারা নারী শিক্ষার ভিন্ন পরিবেশকেই নিরাপদ ভেবেছেন ৷ প্রিয় সন্তানের জন্য বেছে নিয়েছেন ৷
তাই, আসুন ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গী কে সঠিকভাবে উপলব্ধি করার চেষ্টা করি ৷ আগে নৈতিক ও আদর্শিক জীবনকে নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেই৷ সম্ভাবনাময় প্রতিভাগুলোকে ধ্বংসের শঙ্কিত পথগুলোকে বন্ধ করে দেই ৷ অভিশপ্ত সহশিক্ষাকে না বলি ৷ গ্রামে গ্রামে শহরে শহরে বালক বালিকাদের পৃথক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলি ৷ মেয়েদের জন্য পর্দার বিধানকে বাধ্যতামূলক করে দেই ৷ পরিকল্পিতভাবে এব্যাপারে তাদেরকে উৎসাহিত করি ৷ কুরআন হাদিস ও আলেম উলামাদের কথার যথার্থ মর্ম উপলব্ধি করার চেষ্টা করি ৷ প্রগতিবাদের উড়ো অহমিকায় আত্মঘাতি প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসি ৷ আপন প্রজন্মকে নিজ হাতেই নষ্ট না করি ৷ দেশ ও মানুষের জন্য তাদের নিরাপদ ভবিষ্যত কে নিশ্চিত করি ৷ অশ্লিলতা ও অবাধ জীবনাচারের অন্ধকার তুফান যেন শিক্ষার কোমল প্রদ্বীপ কে নিভিয়ে না দেয়, এব্যাপারে ভেবেচিন্তে সিন্ধান্ত নেই ৷
আর আমি যদি গর্বিত মুসলমান হয়ে থাকি, তাহলে হুজুগে দুনিয়ার রঙ্গীণ স্বপ্নের মাকাল ফল যেন আমার ও আমার সন্তানের পারলৌকিক জীবনকে হুমকির সম্মুখীন না করে সেব্যাপারেও সতর্ক থাকার চেষ্টা করি ৷
লেখক, শাইখুল হাদিস, জামেয়া ফারুকিয়া সোনারগাঁ ৷