তালাক সম্পর্কিত কিছু ভুল ধারণা এবং তার সঠিক বিধান
আমীর হামযাহ
তালাক, একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা ইসলামী সমাজে গভীরভাবে প্রভাব ফেলে। বিবাহ এবং পারিবারিক সম্পর্কের মূল ভিত্তি হল বিশ্বাস, স্নেহ, এবং সহযোগিতা, কিন্তু কিছু সময়, নানা কারণে, এই সম্পর্কের বিচ্ছেদ ঘটাতে হতে পারে। ইসলামে তালাক একটি শেষ বিকল্প হিসেবে বিবেচিত হয় এবং এটি এমন একটি পদ্ধতি যার মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রী একে অপর থেকে আলাদা হয়ে যান। তবে, তালাক সম্পর্কে সমাজে নানা ভুল ধারণা প্রচলিত রয়েছে, যা সঠিকভাবে জানার জন্য সবারই সচেতন হওয়া প্রয়োজন।
তালাক। এই শব্দটি শুনলেই আমাদের মনে বিভিন্ন ধরনের অনুভূতি উদিত হয়—কিছুটা ভয়, কিছুটা অস্বস্তি, কিছুটা দুঃখ এবং অনেক ক্ষেত্রে ভুল ধারণা। তবে এই শব্দটির গভীরে যে সঠিক শিক্ষাগুলি নিহিত রয়েছে, তা অনেকেই জানেন না। বর্তমান সমাজে তালাক নিয়ে প্রচলিত অনেক ভুল রয়েছে, যার কারণে মানুষ একে অনেকে ভুলভাবে গ্রহণ করে। আসলে তালাক ইসলামী শাস্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে এটি কীভাবে এবং কখন প্রয়োগ হবে, তারও একটি নির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন রয়েছে, যা অনুসরণ করা উচিত।
১. একসঙ্গে তিন তালাক দিলে তা কার্যকর হয় না
এটি একটি মারাত্মক ভুল ধারণা। কিছু মানুষ বিশ্বাস করেন যে, একসঙ্গে তিন তালাক দিলে তা কার্যকর হয় না এবং তা শুধুমাত্র এক তালাক হিসেবে গন্য হয়। কিন্তু ইসলামী শরীয়তে, একসঙ্গে তিন তালাক দেওয়া না শুধুমাত্র নিষিদ্ধ, বরং এটি কার্যকরও হয়। এর ফলে, স্ত্রীর সঙ্গে পুনরায় সম্পর্ক স্থাপন করা সম্ভব হয় না যতক্ষণ না সে অন্য কাউকে বিয়ে করে এবং ওই স্বামী দ্বারা তালাকপ্রাপ্ত না হয়।
২. তালাকের সঙ্গে ‘বায়েন’ শব্দ ব্যবহার করা জরুরি
অনেক মানুষ মনে করেন যে, ‘তালাক’ বললেই তা কার্যকর হয় না, বরং ‘বায়েন’ শব্দটি ব্যবহার করা আবশ্যক। এটি একেবারেই ভুল ধারণা। ইসলামে ‘তালাক’ শব্দটি নিজেই যথেষ্ট এবং এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে কার্যকর হয়। ‘বায়েন’ শব্দটি যোগ করার মাধ্যমে সম্পর্কের পুনঃমিলন সম্ভব হয় না, বরং এটি শরীয়তের বিধান অনুযায়ী নিষিদ্ধ।
৩. তিন তালাক ছাড়া তালাক হয় না
এটি একটি প্রচলিত ভুল ধারণা যে, এক বা দুই তালাক দিলে সম্পর্কের বিচ্ছেদ ঘটে না এবং শুধুমাত্র তিন তালাক দিলে তা চূড়ান্তভাবে কার্যকর হয়। ইসলামী শরীয়ত অনুসারে, এক বা দুই তালাকও সম্পূর্ণ কার্যকর এবং বৈধ।
তবে, তিন তালাকের ক্ষেত্রে একটু ভিন্ন বিধান রয়েছে। যদি একসঙ্গে তিন তালাক দেওয়া হয়, তবে তা সম্পর্কের চূড়ান্ত বিচ্ছেদ ঘটায় এবং স্ত্রীর সঙ্গে পুনরায় সম্পর্ক স্থাপন করতে হলে নতুনভাবে বিবাহ করতে হবে। কিন্তু এক বা দুই তালাকের ক্ষেত্রে, সম্পর্ক পুনরায় স্থাপন করা সম্ভব যদি উভয় পক্ষ সমঝোতায় আসে এবং স্ত্রীর পক্ষ থেকে পুনরায় বিবাহের সুযোগ থাকে।
৪. গর্ভাবস্থায় তালাক দিলে তা কার্যকর হয় না
একটি সাধারণ ভুল ধারণা হল যে, গর্ভাবস্থায় তালাক দেওয়ার পর তা কার্যকর হয় না। কিন্তু ইসলামে গর্ভাবস্থায় তালাক দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বিধিনিষেধ নেই এবং এটি পূর্ণরূপে কার্যকর। তবে, এটি সামাজিক এবং পারিবারিক ক্ষেত্রে কিছু কঠিন পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে, বিশেষ করে সন্তান জন্মের পর মায়ের দায়িত্ব বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে।
৫. তালাকের জন্য সাক্ষী দরকার
অনেকে মনে করেন যে, তালাক দেওয়ার জন্য সাক্ষীর উপস্থিতি জরুরি। এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। ইসলামী শরীয়ত অনুসারে, তালাকের জন্য সাক্ষী থাকা বাধ্যতামূলক নয়। স্বামী এককভাবে তালাক দিতে পারেন এবং তা কার্যকর হবে। তবে সাক্ষী রাখার উদ্দেশ্য হলো দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতা এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা, বিশেষত যদি কোনো ভুল বোঝাবুঝি হয়ে থাকে।
৬. রাগের অবস্থায় তালাক দিলে তা কার্যকর হয় না
এটি একটি ব্যাপক ভুল ধারণা যে, যদি কেউ রাগের মাথায় তালাক দেয়, তবে তা কার্যকর হয় না। কিন্তু ইসলামী শরীয়তে রাগের মধ্যে বা ঠাট্টা করে দেওয়া তালাকও কার্যকর হয়ে যায়। তালাক একটি আইনি ঘোষণার মতো, যা মানুষের আবেগের থেকে পৃথক থাকে। তাই, রাগের কারণে তালাক দিলে সেটি কার্যকর হয় এবং এর পরিণতি হতে পারে অত্যন্ত গুরুতর।
৭. তালাক দেয়া মানে একে অপরের প্রতি শত্রুতা বা ঘৃণা: অনেক মানুষ মনে করেন, তালাক নেয়ার মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রী একে অপরের প্রতি ঘৃণা বা শত্রুতা প্রকাশ করে। কিন্তু এটা ভুল। তালাক কেবলমাত্র একটি সম্পর্কের পরিসমাপ্তি, এবং এর মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি কাউকে ঘৃণা বা শত্রু মনে করে না। এটা একটি দুঃখজনক কিন্তু বাস্তব পদক্ষেপ হতে পারে, যা ভালোবাসা বা সহনশীলতার অভাবে নেয়া হয়।
৮. তালাক দিতে বা নিতে কোনো শর্তের প্রয়োজন নেই: অনেকেই মনে করেন যে, শুধু স্বামী বা স্ত্রী যে কোন একজনের ইচ্ছায় তালাক দেওয়া সম্ভব, কিন্তু ইসলামের আলোকে এই ধারণা সঠিক নয়। তালাকের আগে বিভিন্ন শর্ত এবং নিয়ম অনুসরণ করা আবশ্যক।
কিছু প্রচলিত প্রশ্ন ও তার উত্তর
১. স্বামীর তালাকের শব্দ কি স্ত্রীর শোনা জরুরি?
অনেকের ধারণা, তালাকের শব্দ স্ত্রীর শুনতে হবে নচেৎ তালাক হবে না। এ জন্য অনেকে বলে থাকে যে স্বামী যখন তালাকের শব্দ উচ্চারণ করছিল তখন আমি কানে আঙুল দিয়ে রেখেছি। অথচ এগুলো ভুল, তালাকের শব্দ স্ত্রী না শুনলেও তালাক পতিত হবে। তাই কানে আঙুল দিয়ে লাভ নেই।
২. তালাকনামায় কি স্বামী–স্ত্রী উভয়ে স্বাক্ষর করা ছাড়া তালাক হয় না?
অনেকের ধারণা, তালাকনামায় স্বামী-স্ত্রী উভয়ে স্বাক্ষর করা ছাড়া তালাক হয় না। অথচ ইসলামের বিধান হলো — যেহেতু তালাক বিবাহের মতো দ্বিপক্ষীয় কাজ নয় বরং তালাক এক পক্ষ থেকেই পতিত হয়ে যায়, আর তালাকের অধিকারী হচ্ছে পুরুষ, তাই তালাকনামায় স্বামী স্বাক্ষর করলেই তালাক হয়ে যায়, স্ত্রীর স্বাক্ষর জরুরি নয়। তবে রাষ্ট্রিয় নিয়ম মেনে চলাতে চেষ্টা করা উচিৎ। তাতে ভবিষ্যতে আইনি ঝামেলা থে দূরো থাকা যায়।
৩. ঠাট্টা করে তালাক দিলে কি পতিত হয় না?
হাস্যরস বা ঠাট্টাচ্ছলে তালাক দিলেও তা পতিত হয়। অনেকের ধারণা — এটি তো দুষ্টুমি মাত্র। এতে কি আর তালাক হবে? হাদিস শরিফে এসেছে, ‘তিন জিনিস ঠাট্টা করে করলেও পতিত হয়ে যায়। বিবাহ, তালাক ও ‘তালাকে রজঈ’ ফেরত নেওয়া।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ২১৯৪)
প্রসঙ্গত : তালাকের সামাজিক, পারিবারিক এবং ধর্মীয় প্রভাব
তালাক শুধুমাত্র দুইজন ব্যক্তির বিষয় নয়, বরং এটি পুরো পরিবারের এবং সমাজের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। স্বামী-স্ত্রী যদি সম্পর্কের বিচ্ছেদ ঘটে, তবে সন্তানদের মানসিক অবস্থা দুর্বল হয়ে পড়তে পারে, যা তাদের ভবিষ্যতের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। তাই, তালাকের সিদ্ধান্তটি অত্যন্ত গুরুতর এবং এটি শুধুমাত্র পারিবারিক নয়, বরং সমাজের জন্যও একটি সংবেদনশীল বিষয়।
ইসলামী সমাজে, তালাককে একটি চূড়ান্ত পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হয় এবং এজন্য, তালাকের পরিণতি এবং প্রভাব সম্পর্কে গভীরভাবে জানা এবং বুঝা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তালাক সম্পর্কিত সঠিক বিধান অনুসরণ করলে সমাজের শান্তি এবং শৃঙ্খলা বজায় রাখা সম্ভব হয়।
তালাক একটি কঠিন সিদ্ধান্ত, যা সমাজের এবং ব্যক্তিগত জীবনের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। আমাদের উচিত, তালাকের সঠিক বিধান এবং এর প্রভাব সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান অর্জন করা, যাতে আমরা ভুল ধারণাগুলোর শিকার না হই। ইসলাম আমাদের শিখিয়েছে যে, তালাক একটি অত্যন্ত গম্ভীর বিষয়, এবং এটি অবলম্বন করার আগে, দাম্পত্য জীবনের সকল সমস্যা সমাধান করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা উচিত।
আজকের সমাজে, স্বামী-স্ত্রীদের মাঝে ভুল ধারণার কারণে তালাকের পরিণতি অনেক সময় মারাত্মক হতে পারে। তাই, তালাকের মাসআলা এবং এর পরিণতি সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান থাকা, প্রত্যেকেরই দায়িত্ব। কেউ যেন রাগ, দুঃখ বা অন্য কোনো কারণে তালাক না দেয়, বরং তারা নিজেদের সম্পর্ক নিয়ে আলেমদের সঙ্গে পরামর্শ করে এবং ইসলামিক বিধান মেনে কাজ করে।