আলোচ্যবিষয়ঃ
- তালাক।
- সংকটের মূল উৎস ও প্রতিরোধ পদ্ধতি।
- সৃষ্ট সংকট থেকে উত্তরণের উপায়।
১। তালাক
সাধারনত যখন কোনো স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্ক এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যে, তাদের আর একসঙ্গে জীবন যাপন করা, একই ছাদের নিচে একসঙ্গে বসবাস করা সম্ভবপর বলে মনে হয় না, তখনই দুঃখজনকভাবে তালাক নামক ‘দুর্ঘটনা’ ঘটে যায়। সৃষ্টি হয় একটা সামাজিক সংকট। তবে কারো কারো ক্ষেত্রে তালাক ছাড়া সত্যই কোনো উপায় থাকে না। অবশ্য আমাদের সমাজে এমনটা নিতান্তই কম।
তালাককে যদিও অনেকে পারিবারিক ঝগড়া-বিবাদ আর অশান্তি-অস্থিরতার প্রতিকার মনে করে, কেউবা আবার মনে করে রাগ-ক্ষোভ-বিদ্বেষ মেটানোর ‘উপযুক্ত হাতিয়ার’; কিন্তু বাস্তবে এসবের জন্য তালাক একেবারেই সাময়িক একটা মাধ্যম মাত্র। সাধারনত আমাদের সমাজে তালাকের দ্বারা স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া-বিবাদ নিরসন হয় না, অশান্তি-অস্থিরতাও দূর হয় না; বরং আমাদের সমাজের বাস্তবতায় তালাক একটি সামাজিক বিপর্যয় সৃষ্টিকারী বিষয়। যার ফলে পরিবারের সদস্যদের মাঝে বিভেদ ও বিচ্ছেদ তৈরি হয়, পারিবারিক বিবাদ-বিসংবাদ, ঝগড়া-মারামারি-অশান্তি পূর্বের তুলনায় আরো বৃদ্ধি পায়। শিশু সন্তানগুলো অসহায় হয়ে পড়ে। কখনো তারা মা-বাবা দু’জনের মাঝে ভাগাভাগি হয়ে জীবন কাটাতে বাধ্য হয়। কখনোবা যেকোনো একজনের কাছেই থাকতে হয় অপরজনের মায়া-মমতা থেকে বঞ্চিত হয়ে। মোটকথা- একটি পবিত্র বন্ধনকে কেন্দ্র করে দু’টি পরিবারের মধ্যে যে সুন্দর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, তা হুমকির মুখে পড়ে। অযাচিত ও বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয় সমাজের কতগুলো মানুষ।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বর্তমানে বহুবিধ বিপর্যয় সৃষ্টিকারী এই সংকটটি আমাদের সমাজে মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে বহু মানুষ হারিয়ে ফেলছে তাদের সুখ ও স্বপ্নের ঠিকানা ‘পরিবার’। তারা হয়ে পড়ছে একাকী, বিচ্ছিন্ন, নিকটজন ও বৈধ সঙ্গীবিহীন অ-সুখী মানুষ। আর এসবেরই অশুভ পরিণামরূপে ভেঙে পড়ছে পুরো সমাজব্যবস্থা। নষ্ট-কলুষিত হচ্ছে সভ্যতা ও সংস্কৃতি।
তাই এই প্রবন্ধে আমরা তালাক নামক সামাজিক সংকট ও তার থেকে উত্তরণের উপায় নিয়েই আলোকপাত করার চেষ্টা করব। ইনশাআল্লাহ।
২। সংকটের মূল উৎস ও প্রতিরোধ পদ্ধতি।
এ শিরোনামে আমরা সংকটের মৌল উৎসের কয়েকটি দিক ও তার প্রতিরোধ পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করব।
(ক) উপযুক্ত সঙ্গী নির্বাচন।
অনেক যুবক-যুবতী (ও তাদের পরিবার) সঙ্গী নির্বাচনের সঠিক মানদণ্ডের প্রতি লক্ষ রাখে না। ফলে তারা বর/কনের বাহ্যিক সৌন্দর্য, আর্থিক প্রাচুর্য আর পারিবারিক প্রভাব-প্রতিপত্তি দেখেই আকৃষ্ট হয়ে যায়। অথচ দুই তরুণ-তরুণীর পরবর্তী সুখের জীবনের ভিত্তি যেই স্বচ্ছ-পবিত্র দ্বীনদারী ও ঈমান-আকীদার ওপর, তার প্রতি তারা ভ্রুক্ষেপই করে না। ফলে পরবর্তীতে তাদের উভয়কে, এমনকি উভয়ের পরিবারকেও বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় এবং এক পর্যায়ে উপায় না পেয়ে, ‘সমাধানে’র নামে তারা সেই বিচ্ছিন্নতা ও গভীর সংকটের পথে পা বাড়াতে বাধ্য হয়, যাকে আমরা ‘তালাক’ নামে অভিহিত করে আসছি। তাই তালাক-সংকটের এই মৌল উৎসটি সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং উপযুক্ত সঙ্গী নির্বাচনের সঠিক পন্থা ও কলা-কৌশল জানা থাকা জরুরী। পাশাপাশি এর জন্য স্থিরচিত্তে গভীর ও যৌক্তিক চিন্তা-ভাবনারও প্রয়োজন।
(খ) স্বামী–স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নত হওয়া।
সাধারনত কোনো দম্পতির মাঝে পারস্পরিক আচরণ-সংক্রান্ত অজ্ঞতার ফলেও বিভিন্ন সমস্যা তৈরি হয় এবং পরিস্থিতি তালাক পর্যন্ত গড়ায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হল, স্বামী-স্ত্রী একে অপরের স্বভাব-চাহিদা, আবেগ-অনুভূতি বুঝতে না পারা। সঙ্গীকে নিজের অনুগত বানিয়ে তার রুচিবিরুদ্ধ কোনো সিদ্ধান্ত মানতে বাধ্য করা। বৈবাহিক জীবনকে নিজের ইচ্ছেমত দাবিদাওয়া আদায়ের মহাসুযোগ মনে করা।
যেমন, স্ত্রী তার স্বামীর নিকট মাসিক খরচ বাড়িয়ে দেওয়ার দাবি করল আর স্বামী দাবি মেনে নেওয়ার বিনিময়ে স্ত্রীর ওপরেও নতুন দাবি চাপিয়ে দিল। বলল, তুমি তোমার অমুক বান্ধবীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারবে না, অমুক আত্মীয়ের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে, ইত্যাদী নানান শর্ত-শারায়েত। অথচ এসব আচরণ না দ্বীনী দৃষ্টিকোণ থেকে গ্রহণযোগ্য, আর না বিবেক এসবকে সমর্থন করে। কেননা, দাম্পত্য জীবন তো টিকে থাকে পারস্পরিক ভালবাসা-সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি ও সমঝোতার ওপর; দাবিদাওয়া কিংবা শর্ত-শারায়েতের ওপর নয়।
যিনি স্বামী, তার তো একথা বোঝা অত্যন্ত জরুরি যে, তার ‘সঙ্গী’টি তার মালিকানাধীন বাদী-দাসী নয়, কাজের বুয়াও নয়; বরং সে হল তার প্রাত্যহিক জীবনের ‘অর্ধাঙ্গিনী’। এবং একথা বোঝাও জরুরি যে, তার জন্য স্ত্রীর ব্যক্তিগত জীবনের সব ক্ষেত্রে কর্তৃত্ব করারও অধিকার নেই।
স্ত্রীদের জন্য শরীয়ত বিভিন্ন ক্ষেত্রে কিছু ছাড়-সুযোগ দিয়েছে, কোনো কোনো স্বামী সেসব ক্ষেত্রেও স্ত্রীর সঙ্গে কড়াকড়ি করে। কেউবা আবার শরীয়তের নিষিদ্ধ বিষয়েও যথেচ্ছা সুযোগ দিয়ে রাখে। এই উভয়টাই অন্যায়। উভয়টাই পরিণামে ক্ষতি বয়ে আনে। সংকট আর সমস্যা তৈরি করে।
৩। সৃষ্ট সংকট থেকে উত্তরণের উপায়
(ক) পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে দাম্পত্য সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা।
ছোট ছোট সমস্যাও শুরুতেই সমাধানের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া। অগ্রাহ্য না করা। কারণ, পরবর্তীতে এগুলোই দাম্পত্য জীবনকে বিষিয়ে তোলে। প্রয়োজনে ‘সন্ধি’র আশ্রয় নেওয়া। কিছু লোক এই সন্ধির বিষয়টিকে অদ্ভুত মনে করে। অথচ বাস্তবতা হল, তালাকের দ্বারপ্রান্তে উপনীত স্বামী-স্ত্রী বিবাদমান দু’পক্ষের মতো। আর সন্ধির অর্থ হল, একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত স্বামী-স্ত্রী একে অপর থেকে দূরে থাকা। যেন প্রত্যেকেই নিজের ব্যাপারগুলো পর্যালোচনা করে নিতে পারে এবং উভয়ের মাঝে সঠিক অনুভূতি ফিরে আসে। এতে দেখা যায়, অনেকেই নিজেদের ভুলগুলো বুঝতে পারে এবং তারা আগের মনোমালিন্য, ঝগড়া-বিবাদ সবকিছু ভুলে আবার নতুন করে সুন্দর সংসার গড়ে তুলতে সচেষ্ট হয়।
(খ) অবিচ্ছেদের সিদ্ধান্তে অটল থাকা।
অনেক স্বামীই তালাক দেওয়া-না দেওয়ার ব্যাপারটা ঝুলিয়ে রাখে। স্ত্রীর সঙ্গে এমন আচরণ করে যে, উভয়ের মাঝে একটা দেয়াল তৈরি হয়। ‘সম্পর্ক’ আর ‘সম্পর্কহীনতা’র মধ্যবর্তী একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। অথচ এর পরিণাম যে কত ভয়াবহ, সে ব্যাপারে তার হুঁশ থাকে না। তাই সতর্ক থাকা। সর্বাবস্থায় অবিচ্ছেদের সিদ্ধান্তে অটল থাকা, যেন এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি না হতে হয়।
(গ) ‘তালাক’ শব্দ উচ্চারণ থেকে বিরত থাকা।
যিনি স্বামী, তালাক শব্দ উচ্চারণের আগে তাকে অত্যন্ত ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার পরিচয় দিতে হবে। বিভিন্ন রকম পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে মন বিষিয়ে উঠতে পারে, স্ত্রী বা পরিবারের অন্য কারো কোনো কথায়-আচরণে মেজায বিগড়াতে পারে, হতাশা আসতে পারে, জাগতে পারে ক্ষোভও; কিন্তু সর্বদা সতর্ক থাকতে হবে, যেন মুখ ফসকেও ‘তালাক’ শব্দ উচ্চারিত না হয়ে যায়। কারণ, এই একটিমাত্র শব্দ উচ্চারণের ফলেই দাম্পত্য জীবন শেষ হয়ে যায়। বিশেষ করে তিন তালাকের ফলে তো একেবারেই নিঃশেষ হয়ে যায় বৈবাহিক এই পবিত্র বন্ধন।
সাথে সাথে কর্তব্য হল, বেশি পরিমাণে আল্লাহ তাআলার কাছে অভিশপ্ত শয়তান থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করা। আর সমস্যার সমাধানের জন্য শান্তিপূর্ণ পরিবেশে স্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় বসা।
(ঘ) পরিবারের বড় ও বুঝমান সদস্যদের সঙ্গে পরামর্শ করা।
স্ত্রী মায়ের স্মরণাপন্ন হবে এবং অত্যন্ত নম্রতা ও হেকমতের সাথে সমস্যাটি তাঁর নিকট পেশ করবে। স্বামীও পরিবারের বড়দেরকে বিষয়গুলো জানাবে। প্রয়োজনে বাবাসহ পুরো পরিবারকে নিয়েই বসবে আলোচনায়। এতে সবাই মিলে একটি সুন্দর, সুষ্ঠু ও সুচিন্তিত সমাধানে পৌঁছুতে পারবে।
এভাবেই তালাক-সংকটের মোকাবেলা করতে হবে। ইসলামের পারিবারিক আচরনরীতির ব্যাপারে স্বচ্ছ ধারনা থাকতে হবে। বস্তুত, পরিবার ও সমাজের ভাঙন রোধ করে পবিত্র বন্ধনগুলো রক্ষা করতে হলে, সমাজ ও পরিবারে শান্তি, স্থিতি ও সুখবাতাস ফিরিয়ে আনতে চাইলে; সর্বোপরি জীবনকে উপভোগ করতে চাইলে তালাক প্রতিরোধ করতে হবে। তৈরি করতে হবে সঠিক দ্বীনী মূল্যবোধ আর একে অপরের প্রতি রহম ও ভালবাসার বেহেশতী পরিবেশ। ফিরে আসতে হবে ঐক্য, সন্ধি ও সমঝোতার পথে। এ পথেই আছে সুখ, বিচ্ছিন্নতার পথে নয়।