||নূর মুহাম্মদ রাহমানী||
ইসলাম পূর্বকালে সকল সমাজে নির্যাতিত, নিষ্পেষিত ছিল নারী। আইয়ামে জাহেলিয়াতে অর্থাৎ মূর্খ যুগে আরবেও ছিল নারী অত্যন্ত নিম্ন মানের পণ্য-সামগ্রী। কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ ছিল অত্যন্ত অপমানজনক, যার দরুন কোনো কারণ ছাড়াই অধিকাংশকে জীবন্ত পুঁতে ফেলা হতো। যারা বেঁচে থাকত তাদেরও সহ্য করতে হতো বিভিন্ন রকমের জুলুম-নির্যাতন। স্বামীর মৃত্যুর পর পরিত্যক্ত সম্পত্তি পাওয়া তো দূরের কথা, অন্যান্য পণ্য-সামগ্রীর মতো মিরাসের সম্পত্তিরূপে উৎসর্গ ও আত্মত্যাগের উপমা নারীকেই চলে যেতে হতো অন্যের কাছে। পক্ষান্তরে ইসলাম নারীকে দিয়েছে যথাযোগ্য অধিকার এবং সম্মানজনক মর্যাদা। প্রতিহত করেছে জুলুম-অত্যাচার। মানব হিসেবে পুরুষের মতোই সম্মানের আসনে আসীন করেছে বংশের আধার ও গর্ভের ধারক নারীকে। সম্মান-মর্যাদার খাতিরে বানিয়েছে পরিত্যক্ত সম্পত্তির অধিকারী।
ইসলামে দেনমোহরের গুরুত্ব অপরিসিম, এ ছাড়া নারীর সতীত্বই বৈধ হয় না। কল্পনা করা যায় না মোহরানা ছাড়া বিয়ের। এ মর্মে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা কুরআনুল কারিমে ইরশাদ করেন, ‘আর তোমরা স্ত্রীদের তাদের দেনমোহর দিয়ে দাও খুশিমনে। তারা যদি খুশি হয়ে তা থেকে অংশ ছেড়ে দেয়, তবে তা তোমরা স্বাচ্ছন্দ্যে ভোগ করো।’-(সূরা নিসা: ৪) এ সূরারই যাদেরকে বিয়ে করা হারাম এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার পর ইরশাদ হয়েছে, ‘এদেরকে ছাড়া তোমাদের জন্যে সব নারী হালাল করা হয়েছে, শর্ত এই যে, তোমরা তাদেরকে স্বীয় অর্থের বিনিময়ে তলব করবে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করার জন্য-ব্যভিচারের জন্য নয়। অনন্তর তাদের মধ্যে যাকে তোমরা ভোগ করবে, তাকে তার নির্ধারিত হক দান করো। তোমাদের কোনো গোনাহ হবে না যদি নির্ধারণের পর তোমরা পরস্পরে সম্মত হও। নিশ্চয় আল্লাহ সুবিজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।-(সূরা নিসা: ২৪) দেনমোহর না দেয়ার নিয়তে বিয়ে ব্যভিচার সমতুল্য এ বিষয়টিকে কেন্দ্র করে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কালামে পাকে ইরশাদ করেন, ‘হে নবী! আমি তোমার জন্য বৈধ করেছি তোমার স্ত্রীদেরকে, যাদের দেনমোহর তুমি প্রদান করেছ।’ (সূরা আহযাব: ৫০)
মোহরানা বিয়ের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রায় সব আলেম একমত, বিয়েতে ইজাব-কবুলের সময় দেনমোহরের আলোচনা না হলেও স্ত্রী মহর ঠিকই পাবে। তখন অবশ্য মহরে মিছিল পাবে। (মহরে মিছিল হলো কনের বংশের সমমনা নারীর সাধারণত যে পরিমাণ মহর ধার্য হয় তা) বিয়েতে মহরের গুরুত্ব এ থেকেই অনুমিত হয়, বিয়ের সময় সামাজিকতার খাতিরে একটা মোহরানা নির্ধারণ করা হয় বটে। তবে অন্তরে পরিশোধের নিয়ত না থাকলে তার ব্যাপারে হাদিসে কঠিন শাস্তির কথা বর্ণিত হয়েছে। প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ মোস্তফা (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মেয়েকে দেনমোহর দেয়ার প্রতিশ্রæতি দিয়ে বিয়ে করেছে, কিন্তু দেনমোহর পরিশোধের ইচ্ছে নেই, সে কিয়ামতের দিন আল্লাহ পাকের নিকট ব্যভিচারী হিসেবে দাঁড়াতে বাধ্য হবে।’-(মুসনাদে আহমদ, হাদিস ৩৪০) এ মোহর তবে স্ত্রীকে যে ভরণ-পোষণ দিতে হয় এর থেকে আলাদা তা বলাই বাহুল্য।
বিয়ের পর নির্জনবাসে যাওয়ার আগেই স্ত্রীকে দেনমোহরের কিছু হলেও দেয়া মুস্তাহাব। রাসূলে আকরাম (সা.) হযরত আলী (রা.)-কে নির্দেশ দিয়েছেন, কিছু দেয়ার আগে বিবির কাছে যেয়ো না। হযরত আলী (রা.) ওজরখাহি করলেন, আমার কাছে তো কিছুই নেই। রাসূলে কারিম (সা.) বললেন, তোমার কাছে যে লোহার বর্মটি ছিল সেটি কোথায়? ওটাই ফাতেমাকে (রা.) দিয়ে দাও। সাহাবী হযরত আলী (রা.) নির্জনবাসে যাওয়ার পূর্বেই বর্মটি ফাতেমাকে (রা.) দিয়ে দেন।’-(আবু দাউদ শরিফ ১/২৮৯, হাদিস ২১২৬) আল্লাহর রাসূল (সা.) এর উদ্দেশ্য ছিল কিছু না কিছু মোহর যেন আলী (রা.) নির্জনবাসের পূর্বেই পরিশোধ করেন। কিন্তু হযরত আলী (রা.) পূর্ণ মোহরানাই পরিশোধ করে দিয়েছিলেন। কারণ অন্য একটি হাদিসে হযরত আলী (রা.) বলেন, আমি ঐ বর্মটিকে বার উকিয়ায় বিক্রি করেছি। ওটাই ফাতেমার (রা.) দেনমোহর।’-(মাজমাউয যাওয়াইদ ৪/২৮৩) আর আমরা পূর্বেই জেনে এসেছি নবী (সা.) এর কোনো মেয়ের মোহরানা বার উকিয়ার অধিক ছিল না।
বিয়েতে দেনমোহর অত্যাবশ্যকীয়। তবে তা নির্ধারণে ভারসাম্য কাম্য। ইসলাম সর্বোচ্চ পরিমাণ দেনমোহর কত হবে তা নির্ধারণ করে দেয়নি। বিভিন্ন হাদিস থেকে জানা যায়, অত্যধিক দেনমোহর নির্ধারণ ভালো নয়। খুব সহজে স্বামী পরিশোধ করতে পারে এতটুকু দেনমোহরই উত্তম। এ প্রসঙ্গে আমাদের নবী হযরত মুহম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘সে নারী বরকতের মাঝে আছে যাকে প্রস্তাব দেয়া সহজ ও যার দেনমোহর অল্প-স্বল্প।-(মুসনাদে আহমদ)।
দেনমোহর বেশি হওয়া যদি কাম্য হতো এবং বিষয়টি পছন্দনীয় হতো তাহলে মহানবী (সা.) এর বিবিগণ এবং তাঁর কন্যাদের দেনমোহর বেশি হতো নিঃসন্দেহে। অথচ নবীর স্ত্রীদের মোহরও বার উকিয়া (পাঁচশ’ দিরহাম) তথা ১৫০ তোলা রুপার অধিক ছিল না। একমাত্র হযরত উম্মে হাবিবা (রা.) এর মোহরানা চার হাজার দিরহাম ছিল। আবিসিনিয়া সম্রাট নাজ্জাশি তা পরিশোধ করে দিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে ইমাম মুসলিম (রহ.) তাঁর মুসলিম শরিফে উল্লেখ করেন, ‘উম্মে হাবিবা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন তাকে বিয়ে করেন, তখন তিনি ছিলেন আবিসিনিয়ায়। আবিসিনিয়া সম্রাট নাজ্জাশি তাকে বিয়ে দেন এবং তাঁর দেনমোহর আদায় করেন চার হাজার দিরহাম এবং নিজের পক্ষ হতে বিবাহ উপঢৌকন প্রদান করেন। আর তাকে ঐ সকল দিয়ে শুরাহবিল ইবনে হাসানা (রা.)-এর সাথে পাঠিয়ে দেন।’-(নাসায়ী শরিফ, হাদিস ৩৩৫০) নবীকন্যা হযরত ফাতেমা (রা.) এর মোহরানাও পাঁচশ’ দিরহামই ছিল। দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) এর জামানায় লোকেরা অত্যধিক দেনমোহরের প্রতিযোগিতা শুরু করলে তিনি শুনে অনেক কঠিন সতর্কবাণী শোনালেন। মিম্বরে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলেন, ‘সাবধান! তোমরা নারীদের মহর বাড়িয়ো না। কেননা, তা যদি দুনিয়াতে সম্মানের এবং পরকালে আল্লাহ তায়ালার কাছে তাকওয়ার বিষয় হতো তবে তোমাদের অপেক্ষা সেই ব্যাপারে আল্লাহর নবী অধিক উপযোগী ছিলেন, কিন্তু দুজাহানের নবী (সা.) বার উকিয়ার বেশি দিয়ে তাঁর কোনো মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন বলে আমার জানা নেই।’-(আবু দাউদ শরিফ, হাদিস ২১০৬) ফাতেমা (রা.) এর দেনমোহর হিসেবে মোহরে ফাতেমী ধার্য করার যে রীতি সমাজে চলমান তা কিন্তু সুন্নত নয়। সুন্নত হলো স্বামীর আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করে মহিলার সম্মানও যাতে ঠিক থাকে এ পরিমাণ দেনমোহর ঠিক করা। দশ দিরহামের কমে অবশ্য দেনমোহর ধার্য করার অবকাশ নেই।
এ মর্মে একটি হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘হযরত জাবের (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, দশ দিরহামের কমে কোনো মোহরানা নেই।’-(বায়হাকি শরিফ ৭/২৪০) ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী (রা.) এর বক্তব্যেও দশ দিরহামের ব্যাপারে সমর্থন রয়েছে।-(মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদীস ১৬৬৩১; দারাকুতনী, হাদীস ৩৬৫২) এবার দিরহামের হিসাবটি একটু বুঝে নেয়া যাক। এক দিরহামের ওজন ৩.০৬১৮ গ্রাম রুপা। সেই হিসেবে দশ দিরহামের ওজন (সাড়ে সাত মাশা) ৩০.৬১৮ গ্রাম রুপা। আর মোহরে ফাতেমী ৫০০ দিরহাম হচ্ছে (১৩১.২৫ তোলা) ১৫৩০.৯ কিলোগ্রাম রূপা।-(শরহু মুখতাসারিত তাহাবী ৪/৩৯৮)।
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, আজ সমাজজীবনে দেনমোহর বিষয়ে সীমাহীন বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ি চোখে পড়ার মতো। বিত্তশালীদের কাছে অত্যধিক দেনমোহর নিয়মিত গর্বের বিষয়। সক্ষমতা থাকলে বেশি দেনমোহর নির্ধারণ জায়েয বটে। কিন্তু সম্মান কুড়ানোর জন্য কোনোভাবেই জায়েয হবে না। বিয়েতে বরপক্ষ থেকে বিভিন্ন উপঢৌকন ও চাওয়া-পাওয়া থাকে। এজন্য কনেপক্ষ থেকেও বেশি মোহরের জন্য চাপাচাপি করা হয়। সবচে’ দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, দেনমোহর পরিশোধ করার অনুরাগ খুব কম দেখা যায়। অনেকেই মনে করে, স্বামী-স্ত্রী বিচ্ছেদের মওকা আসলেই একমাত্র দেনমোহর দিতে হয়, অন্যথায় দিতে হয় না। অনেক নারীও আছে যারা দেনমোহর চাওয়া বা গ্রহণ করাকে দোষণীয় মনে করে। স্বামী দেনমোহর দিতে চাইলে স্ত্রী ভাবে, সে হয়তো আমাকে তালাক দিতে চাচ্ছে। অনেক যুবক আছে যাদের দেনমোহর পরিশোধের ইচ্ছেই থাকে না। তারা বিয়েতে দেনমোহরকে সামাজিক রীতি মনে করে। এজন্য দেখা যায়, বর অনেক বেশি দেনমোহর কাবিননামায় লেখাতেও প্রস্তুত থাকে। অথচ দেনমোহর না দেয়া বা না দেয়ার নিয়ত থাকা মস্ত বড় পাপ। এটা আইনত বিয়ে হলেও আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জতের কাছে ব্যাভিচারতুল্য। অনেকের দেনমোহর পরিশোধের ইচ্ছে আছে কিন্তু তা আদায়ে ছুতা খোঁজে। করে চরম অবহেলা। অথচ দেনমোহরও ঋণ অন্যান্য ঋণের মতো। অনেক স্বামী চাপ প্রয়োগ করে বা এর জন্য কোনো পলিসি অবলম্বন করে মৌখিকভাবে মাফ করিয়ে নেয়। যদি স্বামী বলপ্রয়োগ নাও করে তবে স্ত্রী অসন্তুষ্টিতে মনে মনে এ ভেবে মাফ করে দেয়, দেনমোহর তো পাবোই না, নাজানি দেনমোহর মাফ না করার কারণে দাম্পত্য জীবনে টানাপড়েন সৃষ্টি হয়।
খুব ভালো করে বুঝতে হবে, উপরোক্ত সূরতগুলোতে প্রকৃতপক্ষে দেনমোহর মাফ হবে না। মাফের বিষয়টি তখনই ধর্তব্য হবে যখন স্ত্রী সম্পূর্ণ খুশিমনে মাফ করে দিবে। স্ত্রী মাফ করে দিলেও স্বামীর আত্মসম্মানের দাবি এটাই, সে স্ত্রীর মোহরানা যথাশীঘ্রই বুঝিয়ে দেবে। মোহরের মধ্যে জেওর-গয়নাগাটি শামিল করা যায়। তবে বিয়ের সময় বা বিয়ের পরে মোহরানার টাকা থেকে গয়নাগাটি দেয়া হলে অবশ্যই স্ত্রীকে জানিয়ে দেয়া কর্তব্য। সময়মতো না বলে, পরবর্তীতে ওটা মোহরানার অর্থ ছিল বলা অনুচিত।
লেখক : শিক্ষাসচিব ও উস্তাজুল হাদিস, জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলুম বাগে জান্নাত, চাষাড়া, নারায়ণগঞ্জ।