আমাদের সমাজে অধিক পরিমাণে আলোচনা হয় স্বামীর প্রতি স্ত্রীর দায়িত্ব, কর্তব্য নিয়ে। যার কারণে মনে হয়, সংসারে স্ত্রীর কোন মূল্যই নেই, স্বামীর সংসারে মুখ বুজে খেটে যাবার জন্যই তার পয়দা। যখন সমাজে এই চিন্তা প্রবল হয় তখন এই সুখের সংসার, এই প্রেমের গার্হস্থ্য স্বামী- স্ত্রীর কাছে অত্যন্ত বীভৎস আকার ধারণ করে। এই বীভৎসতা থেকে সমাজকে মুক্তি দিতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পথ গ্রহণ করাই একমাত্র সমাধান।
হযরত ইবনে উমর (রাঃ) বর্ণনা করেন : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, -শুনে রেখো, তোমরা প্রত্যেকেই তত্ত্বাবধায়ক। আর প্রত্যেকেই তার অধিনস্তদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। ইমাম বা নেতা যিনি শাসন করেন সাধারণ মানুষকে, তাকেও তার অধিনস্তদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। একজন পুরুষ তার বাড়ির লোকদের রাখাল বা প্রহরী। তাকে তার অধিনস্ত লোকদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। নারী তার স্বামীর ঘরের লোকদের এবং সন্তানদের রাখাল বা প্রহরী। তাকে তার অধিনস্ত লোকদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। [সহীহ বুখারী : ৭১৩৮]
পারিবারিক জীবনের শান্তি শৃঙ্খলায় করণীয় :
তবে পারিবারিক জীবনের শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষা করতে, একটি সুন্দর পরিপাটি সংসার উপহার দিতে, একটি ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সুখ-শান্তি, সমৃদ্ধি রক্ষার্থে,সর্বপরি আল কুরআনের বিধি বিধান ও রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাত অনুযায়ী জীবন যাপন করে দুনিয়ার শান্তি ও আখিরাতের মুক্তি হাসিলের জন্য স্বামীকে যেমন বেশ কিছু দায়িত্ব পালন করতে হয়, তেমনি স্ত্রীকেও কতগুলো কর্তব্য পালন করতে হয়।
দাম্পত্য জীবনে যে সকল ক্ষেত্রে পরিমিতিবোধের অভাব পরিলক্ষিত হয় পারস্পরিক সেবা ও শ্রমের মূল্যায়ন করার বিষয়টি তার মধ্যে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। এ অভাব উভয় পক্ষেই। স্বামী যেমন স্ত্রীর দিনমানের পরিশ্রমকে মর্যাদার চোখে দেখছে না, তেমনি স্ত্রীও স্বামীর খাটা-খাটনি ও তার পক্ষ হতে প্রাপ্তির যথাযথ কদর করছে না। বলা বাহুল্য, কলহমুক্ত ও মধুর দাম্পত্য রচনার পক্ষে এটা অনেক বড় বাধা। এর অপসারণ জরুরি। সে জন্য দরকার নিজ প্রাপ্য ও অধিকারের সীমারেখা সম্পর্কে সচেতনতা। কতটুকু আমার প্রাপ্য এবং কতটুকু নয়, তা জানা থাকলেই প্রাপ্তির যথার্থ মূল্যায়ন সম্ভব হয়। অন্যথায় সম্পূর্ণটা পাওয়ার পরও অনেক সময় মনে হয় সব বুঝি পেলাম না। কিংবা প্রাপ্যের বেশি পাওয়া সত্ত্বেও ধরে নেওয়া হয় পাওনাটুকুই পেলাম আর তখন সেই বেশিটুকুর জন্য কোন কৃতজ্ঞতার দায় বোধ থাকে না; বরং অধিকারের সীমানায় ফেলে তারও খুঁত-খামতি ধরা হয় আর এভাবে অন্যপক্ষের সৌজন্য চর্চা ও স্বতঃস্ফূর্ত সেবার করা হয় চরম অমর্যাদা।
মূল দায়িত্ব স্বামীর :
দাম্পত্য সফরের আমীর হিসেবে এ ব্যাপারেও অগ্রণী ভূমিকা স্বামীকেই পালন করতে হবে। প্রথমে তাকেই লক্ষ রাখতে হবে স্ত্রীর প্রতি তার অধিকারের সীমানা। বা তার অধিকার ঠিক কতখানি? এর উত্তর পাই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীসে। তিনি ইরশাদ করেন,
ألا واستوصوا بالنساء خيرا، فإنما هن عوان عندكم ليس تملكون منهن شيئا غير ذلك
শোন হে! তোমরা আমার পক্ষ হতে নারীদের প্রতি সদাচরণের উপদেশ গ্রহণ কর। তারা তো তোমাদের কাছে আটকে আছে। তোমরা তাদের কাছ থেকে এছাড়া আর কিছুর অধিকার রাখো না। [জামে তিরমিযী : ১০৮৩]
শরীয়তের দৃষ্টিতে বিবাহ :
মূলত শরীয়তের দৃষ্টিতে বিয়ে এমন একটি চুক্তি বিশেষ, যাতে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের দায়িত্ব ও অধিকার শরিয়ত কর্তৃক নির্ধারিত। এ চুক্তিতে শরিয়তের নির্ধারণের বাইরে কোনো কিছু কমানো-বাড়ানোর সুযোগ নেই।
এমনকি স্বামী-স্ত্রী নিজেরাও কোনো কিছুর হেরফের করতে পারবে না, প্রচলিত প্রথাও বৈবাহিক দায়িত্বের কোনো কিছু বাড়াতে-কমাতে পারবে না। কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে সংসার জীবনে স্ত্রীর যে সব দায়িত্ব ও করণীয় অবধারিত প্রমাণিত হয় সেগুলো আলোচনা করা হলো।
স্বামীর প্রতি নারীর দায়িত্ব ও কর্তব্য :
শরিয়ত স্বামীর যে অধিকার স্ত্রীর ওপর সাব্যস্ত করেছে, তা হচ্ছে—(ক) স্বামীর অনুগত ও নিজেকে হেফাজতে রাখবে; (খ) স্বামীর ঘরের সম্পদ ও সন্তানসন্ততির রক্ষণাবেক্ষণ করবে; (গ) স্বামীর অনুমতি ছাড়া কাউকে ঘরে থাকার অনুমতি দেবে না; (ঘ) বিশেষ জৈবিক চাহিদা পূরণে স্বামী যখন ডাকবে, শরয়ী ওজর না থাকলে তাতে অবশ্যই সাড়া দেবে এবং (ঙ) স্বামীর গৃহেই অবস্থান করবে, তার অনুমতি ছাড়া কোথাও যাবে না ইত্যাদি। [সুরা নিসা : আয়াত ৩৪; সহীহ বুখারী : ৫১৯৫; সুনানে তিরমিযী : ৩০৮৭]
এর বাইরে আর কোনো কাজ করতে স্বামীর সংসারে স্ত্রী আইনতঃ বাধ্য নয়। অতএব, সংসারের জন্য রান্নাবান্না, ঘর-সংসারের আনুষাঙ্গিক কাজ থেকে শুরু করে কোনো গার্হস্থ্য কাজ স্ত্রীর জন্য আবশ্যক নয়।
শরীয়তের দৃষ্টিতে ঘর-সংসারের কাজে নরীর কর্তব্য :
স্ত্রী যদি এমন পরিবারের মেয়ে হয়ে থাকে যে পরিবারের মেয়েরা বাপের বাড়িতে ঘর-সংসারের কাজ করে না, তাহলে স্বামীর কর্তব্য স্ত্রীর খাবার রান্না করার ব্যবস্থাসহ তার কাপড়-চোপড় ধৌত করার ব্যবস্থা করা। আর যদি স্ত্রী এমন পরিবারের মেয়ে হয়, যে পরিবারের মেয়েরা বাপের বাড়িতে ঘর-সংসারের কাজ নিজ হাতে করে; তাহলে স্ত্রীর ওপর নৈতিক দায়িত্ব এসে যায় নিজের খাবার নিজেই তৈরি করা ও নিজের পোশাক-পরিধেয় নিজেই ধৌত করা।
কিন্তু সেক্ষেত্রেও স্ত্রী যদি রান্নাবান্না করতে বা ঘর-সংসারের কাজ করতে অস্বীকার করে, তাহলে স্বামী তাকে আইনতঃ বাধ্য করতে পারবে না।
এই হলো- শরয়ী আইনের কথা। কিন্তু সুষ্ঠু, সুন্দর ও হৃদ্যতাপূর্ণ একটি সংসারের জন্য ইসলামে আইন ছাড়াও রয়েছে আদর্শিক দিক। মূলতঃ ইসলামের অনুসরণীয় ব্যক্তিদের ও মুসলমানদের পারিবারিক জীবনের ঐতিহ্য দাঁড়িয়ে আছে ইসলামের সুদৃঢ় আদর্শিক ভিত্তির ওপর।
দাম্পত্যজীবন আইন দিয়ে নয়; আদর্শ দিয়ে মধুর হয় :
আমরা জানি আইন হয় অধিকার আদায়ের জন্য। কেউ যদি তার অধিকার যথাযথভাবে বুঝে নিতে চায়, তবে তার জন্য ইসলামে রয়েছে আইন ও আদালত। কিন্তু কেউ যদি শান্তি-সুখ চায়, স্বস্তি ও প্রশান্তির জীবন চায়- তার জন্য রয়েছে ইসলামের পারিবারিক জীবনের আদর্শিক দিক। তাকে আইনের থেকে ঊর্ধ্বে উঠে আদর্শের অনুসারী হতে হবে। সংসার ও দাম্পত্য জীবনের সুখ আইনের রুষ্ঠতায় নয় বরং আদর্শের কোমলতায় নিহীত।
এ সব আদর্শের চর্চা হয়েছে নবী করিম সাল্লাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সংসারে এবং সাহাবাদের সংসারে। কিন্তু আদর্শিক দিকটি মানতে কেউ বাধ্য নয় এবং অপরকে তা জোর করে মানানোর সুযোগও নেই, এটা একান্তই ঐচ্ছিক।
নবী কারীম সাল্লাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর স্ত্রী ও তাঁর মহিলা সাহাবিদের সবাই নিজেদের সংসারের কাজ নিজেরা করতেন। এমনকি তাদের মধ্যে যাদের ঘরে এক বা একাধিক দাসী ছিল তারাও সংসারের শতভাগ কাজ দাসীদের দ্বারা করাতেন না। বরং নিজেরা কাজে হাত দিতেন। সম্ভবত নবী ও সাহাবিদের পারিবারিক জীবনের এমন একটা বর্ণনাও পাওয়া যাবে না, যাতে প্রমাণিত হবে কোনো একজন মহিলা সাহাবি স্বামীর ঘরে কোনো কাজই করতেন না। বরং হাদিস গ্রন্থগুলোতে বিশেষত মহিলা সাহাবিদের জীবনী গ্রন্থগুলোতে বিপরীত বর্ণনাই প্রচুর পাওয়া যায়। সে সব বর্ণনাতে দেখা যায়, মহিলা সাহাবিরা স্বামীর সংসারের কাজগুলো নিজেরাই করতেন।
হজরত আলী রা. বর্ণনা করেন, জাঁতা দিয়ে গম ভেঙে আটা গুঁড়ো করতে করতে (নবী কন্যা) হজরত ফাতেমা রা.-এর হাতে ঠোসা পড়ে গিয়েছিল। তাই তিনি নবী কারীম সাল্লাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে গিয়েছিলেন একজন দাসীর জন্য। বাড়ি যেয়ে যখন পিতাকে পেলেন না, তখন মা হজরত আয়েশা রা.-কে সব কিছু জানালেন। হজরত আয়েশা রা. নবী কারীম সাল্লাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে হজরত ফাতেমা রা.-এর আগমনের সংবাদ পৌঁছে দিলেন। যখন নবীজী বাড়িতে আসলেন তখন মা আয়েশা ও ফাতেমা এক বিছানায় শোয়েছিলেন। যখন নবী কারীম সাল্লাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসলেন, তখন নবীজীর শব্দ শোনে তারা উঠতে গেলে নবী কারীম সাল্লাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের উঠতে বারণ করলেন। নিজে যেয়ে তাদের মাঝে বসলেন। পরে হজরত ফাতেমা রা.কে বললেন, তুমি আমার কাছে যা চাচ্ছো তার চেয়ে আরও ভালো জিনিস আমি তোমাকে দেব কি? তুমি যখন বিছানায় শোবে তখন ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ বলবে, ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ বলবে এবং ৩৪ বার আল্লাহু আকবার বলবে। -[সহিহ বোখারি: ৩১১৩ ও সহিহ মুসলিম: ৭০৯০]
আইন ও আদর্শের সমন্বয়; পারিবারিক জীবনের সুখ!
এক্ষেত্রে আইন ও আদর্শ এবং ফরয ও সুন্নতের সমন্বয়টা এভাবে হবে, স্বামী তার স্ত্রীকে সংসারের কোনো কাজ করতে বাধ্য করবে না। সর্বোচ্চ তাকে উৎসাহিত করা যেতে পারে, অনুরোধ করতে পারে। কিন্তু স্ত্রী সংসারের কাজ করার অপরগতা প্রকাশ করলে বা আগ্রহী না হলে তাকে বাধ্য করা যাবে না। আপর দিকে স্ত্রী সংসারের কাজ সাওয়াব ও খেদমত হিসেবে করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করবে।
সুখী হোক আপনার পারিবারিক জীবন! সুখী হউন আপনি! সুখী হোক সকলে! সুখী হোক সামজ।