মাওলানা ইমদাদুল্লাহ বিন আশরাফ আলী।।
সাধারণ মানুষের কাছে আশুরার দিনের প্রসিদ্ধ একটি আমল হলো পরিবারের লোকদের জন্য ভালো খাবারের ব্যবস্থা করা। এ সম্পর্কে একটি হাদীসও লোকমুখে প্রসিদ্ধ রয়েছে। হযরত জাবির রাযি. থেকে বর্ণিত। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
مَنْ وَسَّعَ عَلَى عِيَالِهِ يَوْمَ عَاشُورَاءَ وَسَّعَ اللَّهُ عَلَيْهِ فِي سَائِرِ سَنَتِهِ
‘যে ব্যক্তি আশুরার দিন তার পরিবার পরিজনের জন্য সচ্ছলতার ব্যবস্থা করবে আল্লাহপাক পুরো বছর তাকে সচ্ছলতার সাথে রাখবেন।’
[তাবারানী কাবীর, ১০/৯৪, হাদীস নং-১০০০৭; বাইহাকী, শুআবুল ঈমান :৫/৩৩১, হাদীস নং-৩৫১২]
হাদীসটি হযরত ইবনে মাসউদ রাযি. থেকে এভাবে বর্ণিত হয়েছে-
مَنْ وَسَّعَ عَلَى عِيَالِهِ يَوْمَ عَاشُورَاءَ لَمْ يَزَلْ فِي سَعَةٍ سَائِرَ سَنَتِهِ
[বাইহাকী, শুআবুল ঈমান:৫/৩৩১, হাদীস নং-৩৫১৩]
হাদীসটি হযরত আবু হুরায়রা রাযি. এবং আবু সাঈদ খুদরী রাযি. থেকেও বর্ণিত হয়েছে। দেখুন, বাইহাকী, শুআবুল ঈমান: ৫/৩৩৩, হাদীস নং-৩৫১৪-৩৫১৫]
উক্ত হাদীসকে কেন্দ্র করে অনেকেই আশুরার দিনে পরিবারের জন্য ভালো খাবারের ব্যবস্থা করে থাকেন। বিভিন্ন বক্তাদের বয়ানেও এর প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতে শোনা যায়। কিন্তু যে হাদীসকে কেন্দ্র করে এই আমলের প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয় সেই হাদীসটি সহীহ কিনা তা আদৌ যাচাইয়ের চেষ্টা করা হয় না। আসুন হাদীসটি সম্পর্কে মুহাদ্দিসগণ কি বলেছেন একটু জেনে নিই।
১. ইমাম আহমদ রহ. বলেন, হাদীসটি সহীহ নয়।
[আল-মানারুল মুনীফ, ইবনুল কায়্যিম, পৃ.১১২]
২. আল্লামা উকাইলী রহ. বলেন, এবিষয়ে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে কোনো কিছুই প্রমাণিত নয়। হ্যাঁ, ইবরাহীম বিন মুহাম্মদ বিন মুনতাশির থেকে কথাটি বর্ণিত হয়েছে।
[আয-যুআফা, উকাইলী:৩/২৫২]
৩. হযরত ইবনে মাসউদ রাযি. এর হাদীস সম্পর্কে উকাইলী রহ. বলেন, আলী ইবনুল মুহাজির এবং হাইছাম (উক্ত হাদীসের দুই রাবী) মাজহুল। অর্থাৎ তারা নির্ভরযোগ্য না অনির্ভরযোগ্য তা জানা যায়নি। আর হাদীস সঠিক নয়।
[আয যুআফা, উকাইলী ৩/২৫২]
৪. আর হাফেয যাহাবী রহ. হাদীসের রাবী আলী ইবনে মুহাজির সম্পর্কে বলেন, তার পরিচয় পাওয়া যায়নি। আর হাদীসটি জাল।
[মীযানুল ই’তিদাল:৫/১৯১]
৫. হযরত আবু হুরায়রা রাযি. এর হাদীস সম্পর্কে উকাইলী রহ. বলেন, হাদীসের রাবী সুলাইমান মাজহুল। অর্থাৎ তিনি নির্ভরযোগ্য না অনির্ভরযোগ্য তা জানা যায় নি। আর হাদীসটি সঠিক নয়। এই হাদীসটি নবীজী থেকে কোন মারফু হাদীসে বর্ণিত হয়নি।
[আল-মওযুআত, ইবনুল জাওযী: ২/৫৭৩]
৬. আল্লামা ইবনে তাইমিয়া রহ. আশুরার দিনে ভালো খাবারের ব্যবস্থা করা, খেজাব লাগানো, সুরমা লাগানো ইত্যাদির কথা উল্লেখ করে বলেন, এগুলো নবীজীর নামে মিথ্যারোপ করা হয়েছে। আশুরার দিনে রোযা রাখার বিষয়টি ছাড়া কোনো কিছুই সহীহভাবে প্রমাণিত হয় নি।
[মিনহাজুস সুন্নাহ: ৭/৩৯; মাজমূউ ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়াহ: ২৫/১৬৮]
তিনি আরো বলেন, সর্বোচ্চ এতটুকু বলা যায় যে, এটা ইবরাহীম ইবনুল মুনতাশির-এর বক্তব্য।
[আয যুআফা, উকাইলী: ৩/২৫২; মাজমূউল ফাতাওয়া, ইবনে তাইময়া:২৫/১৬৮]
৭. আল্লামা যারকাশী রহ. বলেন, এটা প্রমাণিত নয়। এটা তো মুহাম্মদ বিন মুনতাশির-এর বক্তব্য।
[আল আসরারুল মারফূআহ, মুল্লা আলী কারী (রহ.) ৩৪৫; কাশফুল খাফা, আজলূনী: ২/৩৩৭ পৃ.]
৮. আল্লামা ইবনে রাজাব হাম্বলী রহ. বলেন, এর সনদ সহীহ নয়। হাদীসটি বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, তবে কোনোটিই সহীহ নয়।
[লাতাইফুল মাআরিফ পৃ.১১৩]
৯. হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী রহ. হাদীসটি সম্পর্কে ‘মুনকারুন জিদ্দান’ বা খুবই আপত্তিজনক বলেছেন।
[লিসানুল মীযান:৬/৩৩৮, আরও দেখুন, ৮/৩৬৬, ৮/৫৩৯]
মুহাদ্দিসীনে কেরামের উপরোক্ত বক্তব্যগুলো থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, উক্ত হাদীসটি ভিত্তিহীন।
কিন্তু এর বিপরীতে অনেক মুহাদ্দিসের বক্তব্য পাওয়া যায়, যাঁরা হাদীসটিকে যয়ীফ মনে করেন; হাদীসটি জাল একথা মানতে তাঁরা রাজি নন। যেমন হাফেয সাখাভী রহ. আল-মাকাসিদুল হাসানাহ গ্রন্থে, (পৃ. ৪৩১) আল্লামা সুয়ুতী রহ. তার আত তাআক্কুবাত এবং আল-লায়ালিল মাসনুআহ গ্রন্থে (২/১১১-১১৪) আল্লামা ইবনে আররাক রহ. তাঁর তানযীহুশ শারীয়াহ গ্রন্থে (২/১৫৭-১৫৮) মোল্লা আলী ক্বারী রহ. তাঁর আল-আসরারুল মারফূআহ গ্রন্থে পৃ. ৩৪৫; আল্লামা মুনাভী রহ. ফায়যুল কাদীর গ্রন্থে (৬/২৩৫) আল্লামা আজলূনী রহ. কাশফুল খাফা গ্রন্থে (২/৩৩৭-৩৩৮) আল্লামা লাখনৌভী (রহ.) আল-আছারুল মারফূআহ গ্রন্থে (পৃ.১০০) এসম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তাঁদের আলোচনার সারাংশ হলো হাদীসটি দুর্বল; জাল নয়।
সুফিয়ান বিন উয়াইনাহ রহ. বলেন, ষাট বছর যাবত পরীক্ষা করে (অর্থাৎ ষাট বছর আশুরার দিন ভালো খাবারের ব্যবস্থা করে) এটাকে সঠিক পেয়েছি।
[মাজমূউ ফাতাওয়া ইবনু তাইমিয়া: ২৫/১৬৮]
ইমাম বাইহাকী রহ. উক্ত হাদীসকে বিভিন্ন সূত্রে উল্লেখ করে বলেন, যদিও সনদগুলো যয়ীফ কিন্তু যেহেতু হাদীসটি বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত হয়েছে তাই একটি অপরটিকে শক্তিশালী করছে। [শুআবুল ঈমান:৫/৩৩৩]
আল্লামা সুয়ূতী রহ. তাঁর আত-তাআক্কুবাত গ্রন্থে যারা হাদীসকে ভিত্তিহীন বলেছেন তাদের বক্তব্যকে প্রত্যাখ্যান করে বলেন, কখনোই নয়, বরং হাদীসটি সহীহ, প্রমাণিত। [কাশফুল খাফা, আজলূনী:২/৩৩৭; আল-আসরারুল মারফূআহ, পৃ. ৩৪৫]
শায়খ আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ. মুহাদ্দিসীনে কেরামের বক্তব্যগুলো সামনে রেখে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, হাদীসটি জাল নয়; বরং যয়ীফ। একারণেই তিনি আল-মানারুল মুনীফ গ্রন্থের শেষে উক্ত গ্রন্থে উল্লেখিত হাদীসগুলোকে দু’ভাগে ভাগ করেছেন। ১-যেগুলো জাল নয়। ২-জাল। আর উক্ত হাদীসকে প্রথম প্রকারে উল্লেখ করেছেন।
উস্তাযে মুহতারাম হযরত মাওলানা আব্দুল মালেক ছাহেব দা.বা. একবার ফোনে এক প্রশ্নকারীর প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন,
‘মতনটা মুনকার তো। আমল না করলেই ভালো। ইখতেলাফ আছে। কোনো কোনো মুহাদ্দিস সেটিকে আমলযোগ্য বলেছেন। সে হিসেবে কেউ এর উপর আমল করলে আমরা এতে আপত্তি করি না। তবে অনেকে এটিকে মুনকার বলেছেন। যারা মুনকার বলেছেন তাদের বক্তব্য ও সার্বিক বিচারে লক্ষ্য করলে আমার কাছে এটিই সঠিক ও রাজেহ মনে হয়।’
‘মতন মুনকার নয়তো কি! ঐদিন রোযা রাখতে বলা হয়েছে। আবার ভালো খাবারের ব্যবস্থা হলে খাবে কখন? তাহলে يوم عاشوراء এর পরিবর্তে ليلة عاشوراء বলতো!’
‘এখানে اشتباه হয়েছে। الاستذكار- এ এর একটি সনদের ব্যাপারে বলা হয়েছে على شرط مسلم। এটি দেখে ইমাম সুয়ূতী রহ. এবং অন্যান্যরা এটিকে আমলযোগ্য বলেছেন। কিন্তু ঐ সনদটির ব্যাপারে হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী রহ. لسان الميزان এ বলেছেন যে, এই সনদটিতেও সমস্যা আছে, علة خفية এর কারণে। সেই সনদটি পাওয়া গেলে হতো।’
আমাদের করণীয় :
যেহেতু অনেক মুহাদ্দিস উক্ত হাদীসকে ভিত্তিহীন ও মুনকার তথা খুবই অাপত্তিজনক বলেছেন অার দলীলের আলোকে তাঁদের কথাই বেশি সঠিক। তাই উক্ত আমলের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব না দেয়াই উচিত এবং উক্ত হাদীসের প্রচার-প্রসারও না করা উচিত। কিন্তু যেহেতু অনেক মুহাদ্দিস আবার উক্ত হাদীসকে ভিত্তিহীন মানতে নারাজ; বরং তাঁদের মতে হাদীসটি অনেক সনদের কারণে অন্তত আমলযোগ্য যয়ীফ, তাই কেউ যদি উক্ত হাদীসের উপর আমল করে বা এর প্রচার-প্রসার করে তাহলে এনিয়ে তার সাথে ঝগড়া বিবাদ করা উচিত হবে না।