।। নূর মুহাম্মদ রাহমানী ।।
বিয়ে মানুষের একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজন। সমাজজীবনের ভারসাম্য টিকিয়ে রাখতে বিয়ের কোনো বিকল্প নেই। চারিত্রিক উৎকর্ষতা সাধন ও নৈতিক উন্নয়নে বিয়ের ভূমিকা অপরিসীম। সার্বজনীন উপকারিতা থাকার কারণে বিয়ে করতে উৎসাহিত করেছেন আল্লাহ তাআলা। কারণ এতে রয়েছে বিরাট উদ্দেশ্য। রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ হেকমত। এর মাধ্যমে চোখ ও লজ্জাস্থানের হেফাজত হয়। বংশধারা রক্ষা হয়। নেকসন্তান লাভ হয়। স্বামী-স্ত্রীর মাঝে আত্মীক বন্ধন সৃদৃঢ় হয়। অন্তরে প্রশান্তি আসে। জীবনশৃঙ্খলা ফিরে আসে। জীবনে স্বচ্ছলতা আসে। মহান আল্লাহর হারামকৃত বিষয়াবলি থেকে নিজেকে রক্ষা করা যায়। পরিবারের মাঝে মহব্বত-ভালোবাসা শক্তিশালী হয় এবং অশ্লীল ও মন্দ বিষয়াবলি থেকে সমাজ ও জাতিকে রক্ষা করা সহজ হয়। তবে বিয়ের এতসব উপকারিতা পেতে বিয়েটা হতে হবে আদর্শপূর্ণ বিয়ে। এখানে আদর্শপূর্ণ বিয়ের কয়েকটি দিক তুলে ধরা হলো।
দেনমোহরে সহনশীলতা :
ইসলামে বিয়ে সহজ করা হয়েছে। অযথা খরচ বাড়িয়ে যুবকদের বিয়ে বিমুখ করা অনুচিত। বিয়ের অন্যান্য খরচের ন্যায় বিয়ের দেনমোহরও সহনশীল হওয়া কাম্য। পুরুষ পরিশোধ করতে পারে এতটুকু দেনমোহর নির্ধারণ করাই উচিত। উচ্চহারে দেনমোহর নির্ধারণ করতে নবীজি নিষেধ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘উত্তম দেনমোহর হচ্ছে যা সাধ্যের মধ্যে হবে।’ (সুনানে বাইহাকি, হাদিস : ১৪৭২১) দেনমোহর কম হওয়ার মধ্যে লজ্জার কিছু নেই। এটা বরং বরকতের নিদর্শন। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘নিঃসন্দেহে নারীর বরকত হচ্ছে তার প্রস্তাব সহজ হওয়া, দেনমোহর সহজ হওয়া এবং গর্ভধারণ সহজ হওয়া।’ (ইবনে হিব্বান, হাদিস : ২৩৯৫৭) দেনমোহর অধিক হওয়া নারীর সম্মানের নয়। অত্যধিক দেনমোহর নির্ধারণ করতে রাসুল নিষেধ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘তোমরা নারীদের দেনমোহরে সীমালঙ্ঘন করো না, যদি তা পৃথিবীতে সম্মানের বিষয় হতো কিংবা আল্লাহর কাছে তাকওয়ার বিষয় হতো তাহলে তোমাদের মধ্যে এর সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি হতেন আল্লাহর নবী (সা.)। আমি জানি না যে, রাসুল (সা.) ১২ উকিয়ার বেশি (দিরহাম) দিয়ে কোনো স্ত্রীকে বিয়ে করেছেন কিংবা কোনো কন্যার বিয়ে দিয়েছেন।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১১১৪)
বিয়ের ঘোষণা করা :
বিয়ের ঘোষণা করতে ইসলামে আদেশ করা হয়েছে। এতে করে ব্যভিচারের সন্দেহ থেকে বেঁচে থাকা যাবে। আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘এ বিয়ে ঘোষণা করো।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১০৮৯) বিয়ের ঘোষণা বিভিন্নভাবে হতে পারে। বিয়ের ঘোষণার জন্য নারীরা চাইলে দফ বাজাতে পারবে। নবীযুগে নারীরা বিয়েতে দফ বাজাতেন। তবে এটি একান্তই তাদের জন্য। পুরুষদের অংশগ্রহণ এতে বৈধ নয়। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘হালাল ও হারামের মধ্যখানে পার্থক্য হলো দফ বাজানো এবং বিয়েতে আওয়াজ করা।’ (নাসায়ি, হাদিস : ৩৩৬৯)
অলিমা করা :
বাসর যাপনের পর অলিমা করা বিয়ের গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত। এটিও বিয়ের ঘোষণার অর্ন্তভুক্ত। এতে করে জানিয়ে দেওয়া হয় যে, বিয়ের পর বৈধভাবে আমাদের বাসর যাপন হয়েছে, এখন এ মিলনের মাধ্যমে সন্তান জন্মগ্রহণ করলে তার বংশধারা প্রমাণিত হবে। এতে সন্দেহের কোনো সুযোগ নেই। আনাস (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) বিয়ে করলে তাকে বলেছেন, একটি বকরি দিয়ে হলেও অলিমা করো।’ (বোখারি, হাদিস : ২০৪৮) অলিমার তাকিদের বিষয়টি আরও একটি ঘটনা দ্বারা অনুমিত হয়। আলী (রা.) ফাতেমা (রা.)-কে বিয়ের প্রস্তাব দিলে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘বিয়ের মধ্যে অলিমা থাকতেই হবে।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ২২৫২৬) গুনাহের কোনো আয়োজন না থাকলে অলিমার দাওয়াতে উপস্থিত হওয়াও কর্তব্য। নবীজি তাকিদও দিয়েছেন এতে। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের কাউকে অলিমায় দাওয়াত দেওয়া হলে সে যেন তাতে অংশগ্রহণ করে।’ (বোখারি, হাদিস : ৫১৭৩) রোজা কিংবা খাওয়ার কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকলে অলিমা আয়োজকের জন্য দোয়া করে দেওয়া; খাবার খাওয়া কোনো জরুরি বিষয় নয়। উপস্থিত হওয়াই মূখ্য।
খুব জাঁকজমক করে অলিমা করতে হবে বিষয়টি এমন নয়। দামী দামী খাবার ছাড়া সাধারণভাবেও অলিমা হতে পারে। আনাস (রা.) বলেন, ‘নবী (সা.) খায়বার ও মদিনার মাঝে তিন রাত অবস্থান করেছেন, সেখানেই সাফিয়্যা (রা.)-এর বাসর হয়। আমি মুসলমানদের অলিমার দাওয়াত দিলাম। এতে কোনো রুটি ও গোশত ছিল না। বেলাল (রা.)-কে তিনি চামড়ার বিছানা আনতে নির্দেশ করলেন। অতঃপর তা বিছানো হলে তিনি তাতে কিছু খেজুর, পনির ও ঘি রাখলেন।’ (বোখারি, হাদিস : ৪২১৩)
নবদম্পতিকে অভিনন্দন জানানো :
বিয়ের পর নবদম্পতিকে অভিনন্দন জানানো, কল্যাণকামনা করা এবং তার জন্য দোয়া করে আনন্দ দেওয়া উচিত। এটি একটি মুস্তাহাব আমল। আবু হুরাইরা (রা.) বলেন, ‘নবী (সা.) নবদম্পতিকে অভিনন্দন জানাতেন এবং তার জন্য দোয়া করে বলতেন-‘বারাকাল্লাহু লাকা ওয়া বারাকা আলাইকা ওয়া জামাআ বায়নাকুমা ফি খাইরিন।’ অর্থাৎ ‘আল্লাহ তোমাকে বরকত দান করুন, তোমাদের উভয়ের প্রতি বরকত নাজিল করুন এবং তোমাদের কল্যাণের সঙ্গে একত্রে রাখুন।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ২১৩০)
৫. স্বামীর জন্য যা মুস্তাহাব :
স্ত্রীর কাছে প্রথম যাওয়ার সময় কয়েকটি বিষয় স্বামীর জন্য মেনে চলা মুস্তাহাব।
ক. বাসর ঘরে স্ত্রীর সঙ্গে কোমল আচরণ করা :
বাসরের সময় স্ত্রীর সঙ্গে কোমল আচরণ করা। একসঙ্গে পানাহার করা। একই পাত্রে পানাহার করা। তার মন জয় করার চেষ্টা করা। এতে করে স্ত্রী একাকিত্ব অনুভব করবে না। আসমা বিনতে উমাইস (রা.) বলেন, আমি ছিলাম আয়েশার বান্ধবী যে আয়েশাকে সাজিয়ে দিয়েছিল এবং রাসুল (সা.)-এর কাছে দিয়ে এসেছিল। আমার সঙ্গে তখন আরও কয়েকজন নারী ছিল। আসমা বলেন, আল্লাহর কসম! আমি মহানবীর কাছে এক বাটি দুধ ছাড়া কোনো মেহমানদারি পাইনি। আসমা বলেন, এ বাটি থেকে মহানবী (সা.) কিছুটা পান করলেন এরপর আয়েশাকে দিলেন। বালিকাটিকে তখন লজ্জা পেয়ে বসল। আমরা বললাম, তুমি রাসুলের হাত ফিরিয়ে দিও না। তুমি তার থেকে গ্রহণ করো। আয়েশা তা লজ্জাবনত হয়ে গ্রহণ করে পান করলেন। তারপর বললেন, তোমার বান্ধবীদের দাও। আমরা বললাম, আমাদের চাহিদা নেই। নবীজি বললেন, তোমরা ক্ষুধা ও মিথ্যা একত্র করো না।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ২৬৯২৫)
খ. স্ত্রীর মাথায় হাত রেখে তার জন্য দোয়া করা :
প্রথম মিলনের আগে স্ত্রীর মাথায় হাত রেখে দোয়া করা একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ কোনো নারী বিয়ে করলে সে যেন নারীর মাথার সামনের চুল ধরে দোয়া করে-‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা খাইরাহা ওয়া খাইরামা জাবালাতহা আলাইহি ওয়া আউজু বিকা মিন শাররিহা ওয়া মিন শাররি মা জাবালাতহা আলাইহি।’ অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ! আমি তার কল্যাণটুকু এবং যে কল্যাণের ওপর তাকে সৃষ্টি করেছেন, অভ্যস্ত করেছেন তা থেকে আশ্রয় চাই।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ২১৬০)
গ. দুজনে একসঙ্গে নামাজ পড়া :
কোনো কোনো পূর্বসূরী গবেষক আলেম নবদম্পতির একসঙ্গে নামাজ পড়া মুস্তাহাব বলেছেন। শাকিক (রহ.) বলেন, এক ব্যক্তি আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)-এর কাছে এসে বলল, আমি একটি যুবতি বিয়ে করেছি। সে আমাকে ঘৃণা করার আশঙ্কা করছি। বর্ণনাকারী বলেন, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেছেন, নিঃসন্দেহে মিল-মহব্বত আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে এবং ঘৃণা শয়তানের পক্ষ থেকে আসে। সে চায় আল্লাহ যা তোমাদের জন্য হালাল করেছেন তা তোমাদের কাছে ঘৃণিত করতে। তাই নববধু যখন তোমার কাছে আসবে তখন তাকে তোমার পেছনে দুই রাকাত নামাজ পড়তে নির্দেশ দাও।’ (আদাবুজ জাফাফ, আলবানিকৃত পৃষ্ঠা : ২৪)
ঘ. সহবাসের দোয়া পড়া :
স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হওয়ার মুহূর্তে এ দোয়া পড়া-‘বিসমিল্লাহি আল্লাহুম্মা জান্নিবনাশ শায়তানা ওয়া জান্নিবিশ শায়তানা মা রাজাকতানা।’ অর্থাৎ ‘আল্লাহর নামে আরম্ভ করছি। হে আল্লাহ! আমাদের তুমি শয়তান থেকে দূরে রাখো এবং আমাদের তুমি যা দান করবে (মিলনের মাধ্যমে যে সন্তান দান করবে) তা থেকে শয়তানকে দূরে রাখো।’
ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ যখন তার স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হয় এবং বিসমিল্লাহি আল্লাহুম্মা জান্নিবনাশ শায়তানা ওয়া জান্নিবিশ শায়তানা মা রাজাকতানা।’ বলে তারপর তাদের এমন সন্তান নসিব হবে শয়তান যার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।’ (বোখারি, হাদিস : ৩২৭১)
মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে বিয়ের আদর্শগুলো মেনে চলার তাওফিক দান করুন। আমিন।