আমীর হামযাহ
একটি সুস্থ, সুন্দর এবং শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠনের জন্য পরিবার হলো ভিত্তি। ইসলামে একটি আদর্শ পরিবার গঠনের জন্য অত্যন্ত সুস্পষ্ট ও সুদৃঢ় দিকনির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। পরিবার গঠনের প্রাথমিক শর্ত হিসেবে একজন ধর্মপরায়ণ জীবনসঙ্গী বেছে নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পুণ্যবান স্ত্রী কেবল একজন জীবনসঙ্গীই নন, বরং তিনি পুরো পরিবারের জন্য নৈতিকতার বাতিঘর হয়ে ওঠেন।
১. ধর্মপরায়ণ জীবনসঙ্গী নির্বাচন:
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন:
“তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের সঙ্গিনী সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি পাও। আর তিনি তোমাদের মাঝে ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয়ই এতে চিন্তাশীলদের জন্য নিদর্শন রয়েছে।” (সূরা রূম: ২১)
এই আয়াত প্রমাণ করে যে, একজন সৎ এবং ধর্মপরায়ণ জীবনসঙ্গী পারিবারিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার মূল ভিত্তি। নবী করিম (সা.) বলেন:
“নারীদের বিবাহ চার কারণে করা হয়: তাদের সম্পদ, বংশপরিচয়, সৌন্দর্য এবং ধর্মপরায়ণতা। তুমি ধর্মপরায়ণ নারীকে বেছে নাও, তা না হলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।” (সহিহ বুখারী: ৫০৯০)
২. সন্তানদের নৈতিক শিক্ষা:
সন্তানদের নৈতিক গুণাবলি মূলত তাদের মা-বাবার আচার-আচরণ, পরিবারিক পরিবেশ এবং শিক্ষার ওপর নির্ভর করে। ইসলামে সন্তানের সঠিক লালন-পালন ও নৈতিক শিক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। নবী করিম (সা.) বলেন:
“সাত বছর বয়সে সন্তানকে সালাত শেখাও এবং দশ বছর বয়সে সালাত আদায়ে উৎসাহিত করো।” (আবু দাউদ: ৪৯৪)
এই শিক্ষাগুলো সন্তানদের চরিত্র গঠনের ক্ষেত্রে একটি শক্ত ভিত্তি তৈরি করে এবং তাদের ভবিষ্যৎকে আলোকিত করে।
৩. সঙ্গীর প্রভাব:
পরিবার গঠনে সঠিক সঙ্গী নির্বাচন যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি আশপাশের পরিবেশ এবং সঙ্গীরাও ব্যাপক প্রভাব ফেলে। রাসূল (সা.) বলেছেন:
“অসৎ সঙ্গীর চেয়ে একাকী থাকা উত্তম, আর সৎ সঙ্গীর চেয়ে একাকী থাকা খারাপ।” (সহিহ বুখারী: ২৪৩৯)
অন্যত্র তিনি বলেন:
“মানুষ তার সঙ্গীর চরিত্র দ্বারা প্রভাবিত হয়, তাই বন্ধুত্ব ও সঙ্গী নির্বাচনে সতর্ক হও।” (তিরমিযি: ২৩৪৭)
৪. পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও ভালোবাসা:
একটি পরিবারে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এবং ভালোবাসা ছাড়া সুস্থ পরিবেশ বজায় রাখা অসম্ভব। নবী (সা.) বলেছেন:
“যে আমাদের ছোটদের স্নেহ করে না এবং বড়দের সম্মান করে না, সে আমাদের দলের অন্তর্ভুক্ত নয়।” (আদাবুল মুফরাদ: ৩৫৪)
এই শিক্ষা পরিবারের প্রতিটি সদস্যের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার বন্ধন দৃঢ় করে।
৫. সত্যবাদিতা ও নৈতিক শুদ্ধতা:
একটি সুস্থ পরিবারের অন্যতম স্তম্ভ হলো সত্যবাদিতা। পাপের সূচনা সাধারণত মিথ্যা দিয়ে হয়, যা মানুষের অন্তর কলুষিত করে। তাই পরিবারে সত্য কথা বলা এবং মিথ্যা পরিহার করার শিক্ষা দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। রাসূল (সা.) বলেছেন:
“ইসলামের সৌন্দর্য হলো, যা অপ্রয়োজনীয় তা পরিহার করা।” (তিরমিযি: ১৪৮৯)
৬. পরিবারের সময়োপযোগী দিকনির্দেশনা:
একটি পরিবারে নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য অভিভাবকদের দায়িত্ব হলো সন্তানের প্রতি সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদান করা। তারা যেন অপ্রয়োজনীয় ও অনৈতিক কাজে লিপ্ত না হয়, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
৭. ইসলামিক মূল্যবোধ চর্চা:
পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের মধ্যে ইসলামিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এটি কেবল নামাজ বা রোজার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামিক আদর্শ অনুসরণ করাই প্রকৃত সফলতা। আল্লাহ তাআলা বলেন:
“হে মুমিনগণ, আল্লাহকে ভয় করো এবং সৎ লোকদের সঙ্গী হও।” (সূরা তাওবা: ১১৯)
একটি আদর্শ পরিবার গঠনের মূল ভিত্তি হলো ধর্মীয় নৈতিকতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এবং সঠিক দিকনির্দেশনা। একজন ধর্মপরায়ণ জীবনসঙ্গী, সৎ ও শিক্ষিত সন্তান, এবং একটি নৈতিক পরিবেশ পরিবারের শান্তি ও সফলতার চাবিকাঠি। ইসলামিক আদর্শ মেনে চললে একটি পরিবার কেবল দুনিয়ার শান্তিই পাবে না, বরং আখিরাতেও সফলতা অর্জন করবে।
পরিবারের প্রতিটি সদস্য যদি ইসলামের শিক্ষাগুলো যথাযথভাবে চর্চা করে, তবে সে পরিবার হয়ে উঠবে একটি শান্তির নীড় এবং সমাজের জন্য এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।